by Team CAPS, 0 Comments
প্রাণী এই গ্রহে ঈশ্বরের একটি মূল্যবান উপহার। ‘প্রাণী’ শব্দটি বলতে শুধু প্রাণীদেরই নয়, বরং পাখি, পোকামাকড়, গাছপালা, ছত্রাক, এমনকি অতিক্ষুদ্র প্রাণীসহ সব প্রাণবন্ত জীবনোপকরণকে বোঝায়।এ পৃথিবীতে একটি সুস্থ পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রাণীর গুরুত্ব অনেক। প্রতিটি প্রাণীর খাদ্য শৃঙ্খলে এক অনন্য জায়গা রয়েছে, যা বাস্তুসংস্থান নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখে। কিন্তু বর্তমানে অনেক প্রাণী ও পাখি বিপন্ন হচ্ছে।
মানুষ তাদের জমি বিকাশ ও চাষাবাদের জন্য গাছপালা কেটে বন উজাড় করে ফেলছে। তাতে করে বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়াও পশু-পাখির মাংস ও চামড়ার জন্য বন্যপ্রাণী শিকার করা হচ্ছে, যা পৃথিবী থেকে অনেক প্রাণী বিলুপ্তির একটি অন্যতম কারণ। পৃথিবীতে পশু-পাখির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রতি বছর অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’ পালিত হয়।
নানা প্রজাতির পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল আমাদের এই বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন-২০০০) তথ্যমতে, এ দেশে প্রায় ২২ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১০৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির পাখি এবং ১১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে।
এসব প্রাণী দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে। বন্যপ্রাণীরা আমাদের অনেক উপকারে আসে। এ দেশে কিছু বন্যপ্রাণী আছে, যেগুলো বিভিন্নভাবে পরিবেশের ও আমাদের উপকার করে থাকে। এ রকম কিছু প্রাণী-
কেঁচো : কেঁচো সাধারণত নরম ও ভেজা মাটির উপরের স্তরে গর্ত করে বসবাস করে। এরা মূলত মাটির সঙ্গে মিশে থাকা পচা পাতা, পতঙ্গের ডিম, লার্ভা, মৃত পোকার দেহাংশ এবং বিভিন্ন জৈব বস্তু খেয়ে থাকে। কেঁচো মাটি খুঁড়ে মলত্যাগের সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ বের করে ‘কেঁচো কম্পোস্ট’ তৈরি করে। এই সার যেহেতু পরিবেশবান্ধব এবং দামে কম তাই এর ব্যবহার পরিবেশের জন্য খুবই ইতিবাচক।
ব্যাঙ : পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাঙের গুরুত্ব অনেক। ব্যাঙ ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। খাদ্য শৃঙ্খলে ব্যাঙ মধ্যম স্তরের প্রাণী। ব্যাঙ ডেঙ্গু, গোদ রোগ, কলেরা, টাইফয়েড, অ্যানথ্রাক্স ও ম্যালেরিয়ার মতো শত শত রোগবাহী কীটপতঙ্গ খেয়ে এসব রোগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়াও ব্যাঙ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতেও সক্ষম। বাংলাদেশে ব্যাঙের প্রজাতি প্রায় ৬৩টি।
চড়ুই : চড়ুই পাখি প্রধানত অসংখ্য পোকামাকড় খেয়ে থাকে। বিশেষ করে পোকার শুককীট, মুককীট বা লেদাপোকা, যা শস্য উৎপাদন ব্যাহত করে। চড়ুই পাখি এসব পোকার ক্ষতিকর আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করে এর উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
শকুন : শকুনের একটি বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। একে প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলা হয়ে থাকে। নানা ধরনের পচা ময়লা-আবর্জনা খেয়ে রোগ-জীবাণুর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে শকুন। এরা শিকারি পাখি নয়, শুধু মৃত প্রাণীই খেয়ে থাকে। দিন দিন এই উপকারী পাখিটি মানুষের অসচেতনতা ও অবহেলায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বোলতা : বোলতাকে ভিমরুল নামেও ডাকা হয়। এরা ক্ষতিকারক মথ বা মাজরাজাতীয় পোকার ডিম নষ্ট করে ফেলে। বোলতা অন্য পোকামাকড়ের শুককীটের মধ্যে ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম থেকে জন্ম নেয়া বোলতা কীটগুলো অন্য পোকার শুককীটগুলো খেয়ে বড় হয়। কৃষিজ পতঙ্গ নিবারণে বোলতা অনেক সহায়তা করে।
মৌমাছি : মৌমাছি একটি পরিচিত উপকারী পতঙ্গ। এরা মূলত ক্ষুদ্র ও পরিশ্রমী। মৌমাছি থেকে আমরা মোম ও মধু পাই। মধু উৎপাদনের জন্য মৌমাছি বাক্সবন্দি করে চাষ করা হয়, যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
মোম, মোমবাতি ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার ওষুধ ও প্রসাধনী যেমন- স্নো, কোল্ড ক্রিম, সেভিং ক্রিম তৈরিতে মধু ব্যবহৃত হয়। মৌমাছি ফুলের পরাগায়নের মাধ্যমে কৃষিজ ও বনজ গাছপালার ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমানে প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ, বন্যপ্রাণী শিকার, পর্যাপ্ত সংরক্ষণের অভাব, ঘূর্ণিঝড় ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে, যার পরিণামে অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
‘ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ’ নামক বন্যপ্রাণী বিষয়ক সংগঠনের তথ্যমতে, আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে ১৬০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রায় অর্ধেক প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। গণ্ডার, নীলগাই, ডোরাকাটা হায়েনা, বন্য মহিষ, ময়ূর, হাড়গিলা, জলার কুমির, জলার হরিণ ইত্যাদি বর্তমানে বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণী।
এছাড়াও রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, ভোঁদড়, লামচিতা, চিতা, বনরুই, বনগরু, ডোরা কাঠবিড়ালি, সাম্বার হরিণ, কালো ভালুক ইত্যাদি বন্যপ্রাণী এখন বিলুপ্তপ্রায়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতি করতে না পারলে আগামী কয়েক দশকে মোট বন্যপ্রাণী প্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিলুপ্তি হতে পারে।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এর নবম অধ্যায়ের ৪নং তফসিল অনুযায়ী, ‘লাইসেন্স অথবা পারমিটপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কাহারো নিকট হইতে কোন বন্যপ্রাণী, বন্যপ্রাণীর কোনো অংশ, মাংস, ট্রফি অথবা উহা হইতে উৎপন্ন দ্রব্য বা বনজদ্রব্য… উল্লিখিত উদ্ভিদ অথবা উহা হইতে উৎপন্ন দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয় বা আমদানি-রফতানি করেন, তাহা হইলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ এক বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাইলে সর্বোচ্চ তিন বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ ও সচেতনতার। সবাইকে বন্যপ্রাণীর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের শনাক্ত করে শাস্তি দিতে হবে। এর ফলে অন্যরা এসব কাজে নিরুৎসাহিত হবে। সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষায় কাজ করতে হবে। আমাদের অভয়ারণ্যগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং অভয়ারণ্যগুলোতে বন্যপ্রাণী বসবাস উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
