মিসরীয় শহর শারম-আল-শেখে জাতিসংঘের উদ্যোগে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৭ বা কনফারেন্স অব পার্টিজ-২৭) শুরু হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি এ সম্মেলনে উপস্থিত আছেন। এবারের সম্মেলনে অভিযোজন, অর্থায়ন, টেকসই জ্বালানি, নেট জিরো, লস অ্যান্ড ড্যামেজ, ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া গত কপ সম্মেলনগুলোর সফলতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আরও অনেক বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এবারের সম্মেলনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরার প্রধানমন্ত্রী হাভিয়ের এস্ফট জ্যামোরাসহ বিশ্বের ১১০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ও উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহারসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধিরা ছাড়াও এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের মেয়র, সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, জলবায়ুকর্মীসহ অনেকে।
এই সম্মেলনের ষষ্ঠ দিনটিকে ডিকার্বনাইজেশন দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই দিনটিতে মূলত বিভিন্ন সেক্টর থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পাওয়ার সেক্টর, সড়ক পরিবহন, স্টিল শিল্প, হাইড্রোজেন জ্বালানি এবং কৃষি- পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আগামী ১২ মাসের মধ্যে, অর্থাৎ কপ২৮-এর আগে ডিকার্বনাইজেশন বা কার্বনমুক্তকরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগটিকে গতিশীল করতে ২৫টি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে একটি অ্যাকশন প্ল্যান প্রণীত হয়েছে। বিশ্বনেতারা মনে করছেন যে এই পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সস্তা ও সহজলভ্যভাবে ক্লিন এনার্জি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে।
আমরা জানি, তেল, গ্যাস, স্টিল এবং সিমেন্টশিল্পগুলো বেশিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণে ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর ২৫ শতাংশের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরিত হয় এই শিল্পগুলো থেকে। এর মধ্যে স্টিলশিল্পে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই শিল্পটি এত অপরিহার্য যে তা বন্ধ করার কোনো পথ নেই। সে জন্য এই শিল্পে কার্বন নিঃসরণের পদ্ধতির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোরারোপ করা হচ্ছে।
তেল ও গ্যাসশিল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্বব্যাপী ১০ শতাংশের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমিত হচ্ছে। আমরা এটাও জানি, তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সময় মিথেন গ্যাস লিকেজ হয়ে থাকে আর মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য বেশি দায় বহন করতে হয়। উত্তরণ ঘটাতে তাই নবায়নযোগ্য বিকল্প জ্বালানির দিকে নজর দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মিথেন নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনার জন্য ইতিমধ্যে বিশ্বের ১২২টি দেশ বিশ্ব মিথেন চুক্তিতে যুক্ত হয়েছে। কপ২৭-এর ষষ্ঠ দিনের আলোচনায় টেকনোলজি ট্রান্সফার, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এবং ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে কীভাবে তেল ও গ্যাস কারখানা থেকে মানবসৃষ্ট মিথেন নিঃসরণ কমানো যায়, সেটাই বেশি আলোচিত হয়েছে। সবার একমত তৈরি হয়েছে যে কম কার্বন নির্গমন করে বা প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করার সামর্থ্যসম্পন্ন স্টিল কারখানা এবং হাইড্রোজেনে চালিত শক্তি ও টেকসই ব্যাটারিশিল্পের বেশ প্রয়োজন হচ্ছে। আর সেটা করতে হলে স্বচ্ছতার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিলিয়ন পাউন্ডের বিনিয়োগ দরকার। এ জন্য কমপক্ষে ৫০টি বড় আকারের প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করার ক্ষমতাসম্পন্ন শিল্পকারখানা ও শতাধিক হাইড্রোজেন শক্তিধারা পরিচালিত অঞ্চল গঠন করার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি আন্তসীমান্ত পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পগুলোরও বাস্তবায়ন করতে হবে। কপ২৬ বা প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০৪০ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহন থেকে দূষণ রোধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা যেন ২০৪০ সালের মধ্যে করা যায়, সেই লক্ষ্যটিকে বাস্তবে রূপায়ণের প্রচেষ্টা নিতে হবে।
সার হচ্ছে কৃষি উৎপাদনের অপরিহার্য একটি উপাদান। কিন্তু কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও বর্জ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রাস অক্সাইড উৎপাদিত হয়। ইউএস ইপিএর তথ্যমতে, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মোট পরিমাণের ৭ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল নাইট্রাস অক্সাইড। এখনকার বৈশ্বিক মন্দার সংকট মোকাবিলায় খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের অবক্ষয় রোধে করতে কৃষি খাতে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা জরুরি পড়েছে।
বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বের ৭ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়ে থাকে সিমেন্টশিল্প থেকে। এই শিল্পের কাঁচামাল থেকে খাদ ও উদ্বায়ী পদার্থ দূর করার জন্য উচ্চতাপ প্রয়োগে প্রচুর কার্বন নিঃসরণের প্রয়োজন হয়। আবার এই অপরিহার্য শিল্পটিকে তো বন্ধ করার রাস্তা খোলা নেই। তাই এই শিল্পে কীভাবে কার্বন নিঃসরণ করা যায়, সেটার জন্য বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। শিল্পে কার্বনমুক্তকরণের জন্য কপ২৬-এর সময় ফাস্ট মুভার্স কোয়ালিশন গঠন করা হয়েছিল। কয়েকটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও কয়েকটি বহুজাতিকের সমন্বয়ে এই কোয়ালিশন গঠিত হয়েছিল। তাদের প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, এ কোয়ালিশনের অন্তর্ভূক্ত নতুন ১০টি করপোরেট কোম্পানি ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ শতাংশ প্রায় শূন্য কার্বন নিঃসরণের উপেযোগী সিমেন্ট ও কংক্রিট কিনবে।
ডিকার্বনাইজেশন বা কার্বনমুক্তকরণকে গতিশীল করা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পপণ্য তৈরি করার দরকার হচ্ছে। সে জন্য সরকারি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিল্পের মানোন্নয়ন ও প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধিতে বিলিয়ন পাউন্ডের বিনিয়োগ দরকার। সে কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের বিকল্প কিছু নেই। কপ২৭-এর এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলো, ইউরোপিয়ান কমিশন, ভারত, মিসর, মরক্কোর মতো দেশগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য দেশ, নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ও সরকারি মূল প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখবে। তাই শিল্প খাতে অর্থায়ন এবং নতুন উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া এবারের জলবায়ু সম্মেলনে অভিযোজন এবং কৃষির ওপর বড় ধরনের আলোচনা হয়েছে। এ বিবেচনায় ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে যে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা রয়েছে, তা মোকাবিলায় এ আলোচনা পথ দেখাতে পারে। তবে অতীতের সম্মেলনগুলোতে কার্বন নিঃসরণের যে উদ্যোগের কথা বারবার বলা হয়েছিল, তা এখনো বাস্তবায়িত না হওয়াটা হতাশাজনক। সে ক্ষেত্রে এ সম্মেলন নতুন পথ দেখাবে, সেটাই প্রত্যাশা করছি।