by Team CAPS, 0 Comments
বিকাল বেলায় অস্তমিত সূর্যের আলোয় নির্মল বাতাস গায়ে লাগিয়ে হাঁটতে কার না ভালো লাগে! কিন্তু যান্ত্রিকতা আর দূষণ আমাদের এই ভালোলাগাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে। ঢাকা শহরের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে মানুষ নির্মল বায়ুতে শ্বাস নেবে। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ মারা যায় বায়ু দূষণের কারণে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুই ঘটে হার্ট অ্যাটাক থেকে আর বাকি ২৫ শতাংশ ফুসফুস রোগে মারা যায়। বায়ু দূষণের মাত্রা এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। দূষণের শীর্ষে আছে ভারতের দিল্লি। ঠিক তার পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশের ঢাকা। হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যায় শুধু বায়ু দূষণের কারণে। সর্বত্র গাড়ির ধোঁয়া, না হয় কলকারখানার ধোঁয়া। তবে এসবের চেয়েও বেশি দূষণ করছে ঢাকার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ইটভাটাগুলো। ঢাকার চারপাশের এলাকায় প্রায় ৪ হাজার ৫০০টির মতো ইটভাটা রয়েছে। ফলে যেদিক থেকেই বায়ু প্রবাহিত হোক, দূষিত বায়ু প্রবেশ করছে ঢাকা শহরে। ঢাকার আশপাশে গেলেই দেখা যায়- সারি সারি ইটভাটার চিমনি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকার বাতাসে। এ যেন দূষণের মেলা চলছে বাতাসে! পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, ঢাকায় বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে ৫৪ ভাগ বায়ু দূষণ ইটভাটা থেকে হয়ে থাকে।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে বহুতল ভবন নির্মাণে কংক্রিট, অ্যালুমিনিয়াম সিট, প্লাস্টিক, কাচ ফাইবার, স্টিল এবং ধাতব বস্তুর ব্যাপক ব্যবহার হলেও বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে ইট। আর এই ইট তৈরিতে ব্যবহার হয় প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মাটি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা নেয়া হয় কৃষিজমি থেকে। কৃষকদের লোভ দেখিয়ে ইটভাটার মালিকরা এককালীন অল্প কিছু টাকা দিয়ে চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জমির উপরি অংশের উর্বর মাটি কেটে নিয়ে যান ইট তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য। বাংলাদেশে ইটভাটার মালিকরা সাধারণত বছরের অক্টোবর থেকে মার্চ মাসকে ইট তৈরির উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেন।
যে কোনো দেশের জন্য ভূমিক্ষয় একটি মারাত্মক সমস্যা। সব দেশই চেষ্টা করে, যেন ভূমিক্ষয় না হয়। বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার ইট তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে। আর বেশিরভাগ ইটভাটা শুষ্ক মৌসুমে চালু থাকে, যখন দূষণের পরিমাণ এমনিতেই বেশি থাকে। সাধারণত ১ কোটি ইট তৈরি করতে কমপক্ষে আধা লাখ টন মাটির প্রয়োজন হয়, যার পুরোটাই আসে মাটির উর্বর অংশ বা টপসয়েল থেকে। মাটির টপসয়েলই ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান থাকে আর মাটির টপসয়েল তৈরি হতে শত শত বছর সময় লাগে।
যদিও ইটভাটায় লাকড়ি পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ। এসব ইটভাটায় ইট তৈরিতে পোড়ানো হয় কাঠ-কয়লা, কাঠের গুঁড়া, ফার্নেস অয়েল, এমনকি বাতিল টায়ারও ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। আবার ১ লাখ ইট পোড়াতে প্রায় ২০ টন কয়লার দরকার হয়। লাকড়ি হলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। আমাদের দেশে গাছ লাগানো এক প্রকার সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হলেও কিন্তু আমরা এর সুফল পাচ্ছি না। কারণ ব্যাপক হারে বন উজাড় করে লাকড়ি পোড়ানো হচ্ছে। অতিরিক্ত কাঠ ও কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ যা দূষিত করছে বায়ুমণ্ডল। দূষণের মাত্রা এতই বেশি থাকে যে, আশপাশের গাছও মারা যায়। বাতাসের স্বচ্ছতা কমে যায় ধূলিকণার কারণে। উর্বর মাটি না থাকায় ফসলের ফলন কমে যায়। ইটভাটার সৃষ্ট দূষণ পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে জনস্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। চোখ জ্বালাপোড়া ছাড়াও ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
আইন : ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে, কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করিতে পারিবেন না; তবে শর্ত থাকে যে, কংক্রিট কমপ্রেসড ব্লক ইট প্রস্তুত করিবার ক্ষেত্রে এইরূপ লাইসেন্সের প্রয়োজন হইবে না।’ ১. ‘আপাতত বলবৎ অন্য আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হইতে মাটি কাটিয়া বা সংগ্রহ করিয়া ইটের কাঁচামাল হিসেবে উহা ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ ২. ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে মজাপুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দীঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা হইতে মাটি কাটিতে বা সংগ্রহ করিতে পারিবে না।’ ৩. ‘ইটের কাঁচামাল হিসেবে মাটির ব্যবহার হ্রাস করিবার উদ্দেশ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ফাঁপা ইট (ঐড়ষষড়ি ইৎরপশ) প্রস্তুত করিতে হইবে।’ ৪. ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃক নির্মিত উপজেলা বা ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়ক ব্যবহার করিয়া কোনো ব্যক্তি ভারি যানবাহন দ্বারা ইট বা ইটের কাঁচামাল পরিবহন করিতে পারিবেন না।
শাস্তি : ‘যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৪-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত, সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। ১. যদি কোনো ব্যক্তি, ধারা ৫-এর (ক) উপধারা (১)-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া, ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হইতে মাটি কাটিয়া বা সংগ্রহ করিয়া ইটের কাঁচামাল হিসাবে উহা ব্যবহার করেন; বা (খ) উপ-ধারা (২)-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত ইট প্রস্তুতের উদ্দেশ্যে মজাপুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দীঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা হইতে মাটি কাটেন বা সংগ্রহ করেন; তাহা হইলে তিনি অনধিক ২ বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
করণীয় : পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন কর্তৃক মাঠপর্যায়ে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটাগুলো চিহ্নিত করা ও সেগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ করা। সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা। নিষিদ্ধ এলাকার সীমানার মধ্যে বা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্তদের লাইসেন্স বাতিল করা এবং সব কার্যক্রম বন্ধ করা। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা। ১২০ ফুট উচ্চতায় স্থায়ী চিমনিবিশিষ্ট যেসব ইটভাটায় এখনও উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তর হয়নি সেসব ইটভাটা থেকে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ নেয়া।
ইটভাটাগুলোতে দূষণ কমানোর লক্ষ্যে বায়ুশোধন যন্ত্রপাতি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন সংশোধন করে সেটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করলে এই কারণে দূষণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। এর সঙ্গে পুরনো এবং অদক্ষ বুল’স ট্রেঞ্চ পদ্ধতির ইটভাটাগুলো পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করে হফম্যান পদ্ধতিতে রূপান্তর করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে হবে। এই লক্ষ্যে সরকারি অনুদানে হফম্যান পদ্ধতির নির্মাণ ও পরিচালনার ব্যাপারে প্রশিক্ষণের অথবা সাশ্রয়ী ম্যানুয়ালের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নতুন করে ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে পুরনো ও অদক্ষ বুল’স ট্রেঞ্চ পদ্ধতিকে নিষিদ্ধ করাও উচিত হয়। ইট যদি রফতানি করতেই হয় তবে সেটা পরিবেশবান্ধব উপায়ে উৎপাদন করে এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতির জন্য যথোপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করে তবেই করা উচিত। এ ছাড়া প্রচলিত আগুনে পোড়ানো ইটের পরিবর্তে সেন্ড ব্রিকের উৎপাদন ও প্রচলনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতির ফলে আন্তর্জাতিক কার্বন বাণিজ্য থেকে ভর্তুকি আদায়ের ব্যবস্থা করে তা দিয়ে ইটভাটাগুলোর উন্নয়নের খরচ পুরোটাই মেটানো সম্ভব হবে।