by Team CAPS, 0 Comments
সলিম উম্মাহর জন্য ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কুরবানি শব্দের পারিভাষিক অর্থ হলো- নৈকট্য লাভ, ত্যাগ, বিসর্জন, উৎসর্গ ইত্যাদি। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট পশু (প্রিয়) জবেহ করাকে কুরবানি বলে। সামর্থ্যবানদের জন্য এটি ফরজ ইবাদত। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষ ঈদের আনন্দে বিমোহিত হয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা ভুলে যাই। হাদিস শরিফে আছে ‘পবিত্রতা হলো ইমানের অংশ’- সহিহ মুসলিম : ৪২৭।
উন্নত মুসলিম দেশসমূহে কুরবানির জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যিনি বা যারা কুরবানি দেবেন, তিনি বা তারা নিজেদের পালিত পশু বা পছন্দসই গৃহপালিত পশু ক্রয় করে নির্ধারিত স্থানে দিয়ে দেন। ঈদের দিন পশুগুলোকে সরকারিভাবে হালাল ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে জবেহ করে চামড়া, হাড়-মাংস ও বর্জ্য আলাদা করে, শুধু হাড়-মাংস পশু মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অতঃপর চামড়া প্রক্রিয়াজাতের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। রান্নার অনুপযুক্ত হাড় ও অন্য বর্জ্যসমূহ সঠিকভাবে ডাম্পিং/পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে পরিবেশ যেমন সুন্দর থাকে পাশাপাশি কুরবানির মাংস রোগ জীবাণুমুক্ত থাকে।
কুরবানিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পুরোটাই উল্টা আমাদের দেশে আমরা নিজেরাই নিজেদের পশু জবেহ করি অতঃপর চামড়া, হাড়-মাংস ও বর্জ্য আলাদা করি। ফলে অসাবধানতাবশত মাংসে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, অদক্ষ হাতের কারণে চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয় এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় পরিবেশ দূষণ। যত্রতত্র পশুর মলমূত্র, পশুর অবশিষ্ট খাদ্য, জবেহ করা পশুর রক্ত, নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলির বর্জ্য, হাড়, শিং, কান, মাথার চামড়া এবং রক্তে সিক্ত থাকা চাটাই (পাটি) ইত্যাদি আমরা যেখানে সেখানে ফেলে রাখি ফলে নোংরা হয় পরিবেশ। কুরবানির কয়েকদিন সারাদেশ বিশেষ করে ঢাকার মতো জনবহুল এলাকা যেখানে নিষ্কাশন ব্যবস্থা খারাপ সেখানে আমাদের অসাবধানতার কারণেই রক্তসমূহ জমে থাকে এবং ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে বাতাসে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে পশুবর্জ্য ও চাটাই ড্রেনে ফেলে রাখা হয় ফলে নিষ্কাশন ব্যবস্থায় গোলযোগ সৃষ্টি হয়। কুরবানি ঈদ পরবর্তী সময়ে বৃষ্টি হলে মিশ্র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। চারদিকে নোংরা পরিবেশ সঙ্গে পানির উপস্থিতি তাই একই সময়ে দেখা দেয় মশার উপদ্রব। কখনো মশার কামড়ে দেখা দেয় ডেঙ্গু রোগ, সমস্যার যেন অন্ত নেই। সমস্যার মূল কারণ একটাই, আমাদের অসচেতনতা। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের অজ্ঞতাকে দোষ দেয়া যাবে না। কারণ এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে জানে না পশুবর্জ্য ও রক্ত থেকে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, তারপরও বছরের পর বছর ধরে আমরা এই কাজগুলো করে যাচ্ছি এবং পক্ষান্তরে নিজে দোষ না নিয়ে প্রতিবেশীকে দোষারোপ করছি। অনেক উচ্চবিত্ত লোক হয়তো জানেই না যে তার কুরবানির পশুর বর্জ্যরে কি অবস্থা; কারণ তার কুরবানির ব্যবস্থাপনা করে গৃহ কর্মচারী। তাহলে এখানে কী গৃহ কর্মচারীর অজ্ঞতাকে বা অসচেতনতাকে দায়ী করা হবে নাকি মূল মালিকের দায়িত্বহীনতা?
শুধু একটু পরিবর্তনের ছোঁয়া পেলেই বর্জ্য সম্পদে পরিণত হবে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসে গরু বা ছাগলের ভুঁড়ি অনেক আগে থেকেই আছে যা অনেকের কাছে ‘বট’ নামে পরিচিত আবার কিছু মানুষ নাড়িও খেয়ে থাকে। সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করে প্রস্তুত করে রান্না করতে পারলে এগুলো স্বাদে বেশ মজাদার হয়। পশুর নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলির বর্জ্য মাছের উপাদেয় খাদ্য। রক্তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, রক্ত থেকে পুষ্টিকর পশুখাদ্য তৈরি সম্ভব। অপরদিকে হাড়ের গুঁড়া হাঁস-মুরগির উৎকৃষ্ট খাদ্য এবং এটি সার হিসেবেও জমিতে ব্যবহার করা যায়, হাড়-শিং থেকে বোতাম, তৈজসপত্র, ওষুধ, গৃহসজ্জার সামগ্রী ইত্যাদি প্রস্তুত করা যায়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এক আলোচনা সভা থেকে জানা যায় যে, আকার ভেদে একটি গরুতে ১৫ থেকে ২৫ কেজি হাড় উচ্ছিষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষ করে চীন ও থাইল্যান্ডে গরুর হাড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ‘পবা’র সভা থেকে আরো জানা যায় যে, বর্তমানে কুরবানির গরুর হাড়ের বাজারমূল্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা এবং কুরবানির মৌসুমসহ বছরের মোট জবাইকৃত গরুর হাড়ের বাজার মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। প্রতি বছর ল্যান্ডফিল হতে গরুর হাড়-শিং পৃথক ও সংগ্রহ করে সিটি করপোরেশন নিজস্বভাবে লাভবান হতে পারে অথবা এ ব্যাপারে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে তৃতীয় পক্ষকে ইজারা দেয়া যেতে পারে। গ্রাম এলাকা বা যেখানে খোলা জায়গা আছে সেখানে কুরবানির আগে বাসাবাড়ির পাশে খালি জায়গায় একটি গর্ত করে রাখা যায়, পশু জবাইয়ের পর রক্ত, গোবর, পরিত্যক্ত খাবার, কান, শিং, মাথার চামড়া ও পাকস্থলির বর্জ্যসমূহ এই গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিলে কুরবানির ঈদ পরবর্তী সময়ে দুর্গন্ধ ছড়াবে না এবং মশার উপদ্রব ও রোগবালাই সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ২০১৭ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে যথাক্রমে ৬২৫টি ও ৫৪৯টি স্থান কুরবানির পশু জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছিল। পর্যাপ্ত প্রচারণা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে গত বছর এই কার্যক্রমে জনগণ স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশ নেননি। বর্জ্য সংগ্রহের সুবিধার জন্য প্রতি বছর সিটি করপোরেশন থেকে কুরবানির কিছুদিন আগে থেকে পলিব্যাগ বিতরণ করা হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তেমন সুবিধা হচ্ছে না। সাধারণ জনগণের মতে, পলি ব্যাগগুলো আকারে ছোট হওয়ার কারণে একটি স্বাভাবিক আকারের গরুর বর্জ্য ধারণ করা সম্ভব নয়, ফলে অনেকেই এসব বর্জ্য ড্রেনে বা রাস্তায় ফেলে রাখছে। ঈদের সময় সিটি করপোরেশন বেশিরভাগ পরিচ্ছন্নকর্মী বাড়িতে চলে যায় এবং তাদের বদলে কেউ থাকে না ফলে শহরজুড়ে বর্জ্যস্তূপ জমতে থাকে। এ সময় নগর কর্তৃপক্ষের উচিত খণ্ডকালীন বাড়তি লোক নিয়োগ দেয়া, প্রয়োজনে দ্রুত বর্জ্য অপসারণ করতে সক্ষম এমন আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার।
