একবিংশ শতাব্দীর মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করা। এ পরিবর্তন মোকাবেলা ও এর বিরূপ প্রভাব থেকে মানবজাতি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছর বিশ্বের কোনো না কোনো শহরে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন, যা বিশ্বব্যাপী কপ নামে পরিচিত। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরও জাতিসংঘ আয়োজন করেছে জলবায়ু সম্মেলনের ২৭তম আসর। বহু আন্তর্জাতিক সংকটের মীমাংসার ইতিহাস যে ভেন্যুতে (মিসরের উপকূলীয় সবুজ শহর শার্ম আল-শেখের রেড সি রিসোর্ট), সেখানেই এবারের জলবায়ু সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, সম্মেলনটি জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি) চুক্তি গ্রহণের ত্রিশতম বছরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় Delivering for people & the planet (ডেলিভারি ফর পিপল ফর প্লানেট) এবং মূল আলোচনার বিষয়বস্তু অভিযোজন, অর্থায়ন, টেকসই জ্বালানি, নেট জিরো, লস অ্যান্ড ড্যামেজ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা। এছাড়া গত কপ সম্মেলনগুলোর সফলতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়েও আলোচনা চলছে। কপ২৭ নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয়ে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে। মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এবারের সম্মেলনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরার প্রধানমন্ত্রী হাভিয়ের এস্ফট জ্যামোরাসহ ১১০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবারের সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করলেও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এমপি ও উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার এমপিসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধি ছাড়াও সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের মেয়র, সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, জলবায়ু কর্মীসহ অনেকে। মোট ২৭টি অধিবেশনের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে, যার প্রথম দুই দিন বিশ্বনেতাদের বৈঠকের জন্য বরাদ্দ ছিল। ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য বাঁচামরার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। গেল বছরের বন্যা-খরা, অতিরিক্ত তাপদাহ ও ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাগুলো এবারের সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির মুখে আছে মিসর ও বাংলাদেশসহ বহু দেশ। জাতিসংঘ বলছে, ভূ-রাজনীতির কারণে জ্বালানি, খাদ্য ও পানির সংকটে আছে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর ওপর জোর দিয়েছে সংস্থাটি।
এ বছর জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচলার পাশাপাশি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জ্বালানি সংকট, নিরাপদ খাদ্য আর জলবায়ুজনিত ক্ষয়ক্ষতির অর্থ জোগান নিয়েও আলোচনা হয়। এবারো ক্ষতিপূরণ আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আধুনিক প্রযুক্তি পাওয়ার দাবি জানাচ্ছে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। এবার যেহেতু বেশি দেশ সম্মেলনে অংশ নিয়েছে, তাই সংকট সমাধানে ভালো কিছুর প্রত্যাশা বাংলাদেশের। তবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে তৈরি হওয়া জ্বালানি সংকট সমাধানের দিকেই নজর বিশেষজ্ঞদের। বরাবরের মতো এবারো জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর বিপুল ক্ষতি আর হুমকিতে থাকার বিষয়টি জোরালোভাবেই সম্মেলনে উঠে এসেছে। বিশ্ব নেতৃত্ব, কূটনীতিক বা বিভিন্ন দেশের দূত, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধি এবং সিভিল সোসাইটির সদস্যসহ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু এজেন্ডাকে আরো গতিশীল এবং অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছায়। ইমপ্লিমেন্টেশন যেহেতু এবারের জলবায়ু সম্মেলনের মূল বিষয় তাই এ সম্মেলনে ‘ফুড সিকিউরিটির’ ওপর একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু সহনশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আরো বেশি পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ‘জাস্ট ট্রানজিশন’-এর ওপর আরো একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় যেখানে জলবায়ু নেতারা এবং স্টেকহোল্ডাররা জাস্ট ট্রানজিশনের উপায় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন যাতে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক ক্লাইমেট অ্যাকশন মানুষ ও পৃথিবীর রক্ষা নিশ্চিত করে। এছাড়া বিশ্ব নেতারা ‘ইনোভেটিভ ফাইন্যান্স ফর ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। এতে বিশ্ব নেতৃত্ব ও স্টেকহোল্ডাররা জলবায়ু ঝুঁকি রোধে সরকারি ও বেসরকারি উভয় উৎসের অর্থের সুষ্ঠু এবং পরিকল্পিত ব্যবহারের জন্য একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য মতপ্রকাশ করেন। জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে বিশ্বের উন্নত দেশের কার্বন নিঃসরণকারী কোম্পানিগুলোকে অ্যাকাউন্টেবল করার বিষয় এবং বিশ্বের উন্নয়নশীল ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ক্লিন এনার্জিতে স্থানান্তরের জন্য বিশ্বের উন্নত ও কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর আর্থিকভাবে এবং প্রযুক্তিগতভাবে সহযোগিতার বিষয়গুলো আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। এমন অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করে আলাদা তহবিল গঠন, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে খাদ্য উৎপাদনে টেকনোলজির ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রসারণে উন্নত রাষ্ট্রের সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রোধকল্পে সরকারি ও বেসরকারি উভয় উৎসের অর্থের সুষ্ঠু এবং পরিকল্পিত ব্যবহারের জন্য ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে বের হয়ে আসতে পারে। গত ৩০ বছর উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রোধে ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নত ও কার্বন নিঃসরণকারী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান দেশসহ উন্নত রাষ্ট্রগুলো এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছিল না। তবে এবারের সম্মেলনে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিয়ন কপ২৭ সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজের আওতাধীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেন, পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিশেল মার্টিন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করেন। এছাড়া অস্ট্রিয়ার জলবায়ু মন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে ৫০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেন। চতুর্থ দিনে জার্মানি এবং বেলজিয়ামসহ বিশ্বের আরো কিছুসংখ্যক ধনী দেশ এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য তহবিল প্রদান করবে। এর মধ্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মানি, স্কটল্যান্ড, বেলজিয়াম, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ভি-টোয়েন্টি গ্রুপ ৫৮টি উন্নয়নশীল দেশকে কিছু অর্থসহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার করেন। জার্মানি ও বেলজিয়াম জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি ফিরিয়ে আনতে ১৭০ মিলিয়ন ইউরো এবং ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এদিকে জলবায়ু সম্মেলনের চতুর্থ দিনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে তিনটি ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম ইভেন্টে সাউথ এশিয়ান দেশগুলোর মন্ত্রীদের সঙ্গে একটি বৈঠক বা সাক্ষাত্কার অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো এবং তা থেকে উত্তরণে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানান এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কী পরিমাণ অর্থসহায়তা লাগবে সে বিষয়ে আলোচনা করেন। দ্বিতীয় অধিবেশনে লস অ্যান্ড ড্যামেজসম্পর্কিত সাউথ এশিয়ান দেশগুলোর প্রস্তাবিত প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করা হয়। সন্ধ্যার অধিবেশনে ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান অর্থাৎ NAP প্রজেক্ট নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কী কী কাজ হবে এবং এর জন্য প্রস্তাবিত অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার নিয়ে সেমিনারে অংশ নেন বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ বিশ্বের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। সেমিনারে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়ার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ। তাছাড়া চতুর্থ দিন বুধবার সকালের অধিবেশনেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায়বিচার এবং ঋণ উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে এশিয়ান পিপলস মুভমেন্টস নামে একটি মানববন্ধন হয়েছিল। এ মানববন্ধনে লেডি নেকপিল বলেন, ‘জলবায়ুর অর্থায়ন ছাড়া আর কোনো বিচার নেই’। অন্যদিকে সম্মেলনের স্পিকার বলেন, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি সক্ষম হচ্ছে এবং জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। অন্যদিকে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের কক্ষগুলোয় জলবায়ু সম্পর্কিত আলোচনাগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার পাশাপাশি সম্মেলনের বাইরে অনেক সংগঠন জলবায়ুর ন্যায্যতা, ক্ষয়ক্ষতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার এবং জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের যে দাবি উঠিয়েছে তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু সম্মেলনের পঞ্চম দিনে মূলত জলবায়ু বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় এবং তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে চিন্তা ভাবনা, তাদের এক্ষেত্রে সফলতার গল্প ও দাবিগুলো শোনার জন্য প্যানেল আলোচনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি), জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে জলবায়ু বিজ্ঞানের ওপর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এসব রিপোর্টের ফল এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার তার ওপর বিশদ আলোচনা হয়। এছাড়া গবেষক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ভবিষ্যতেও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করতে পারে এবং জলবায়ু বিজ্ঞানভিত্তিক রিপোর্টগুলো ভবিষ্যতেও যাতে প্রকাশ অব্যাহত রাখা যায় তার ওপর আলোচনা হয়। একই সঙ্গে জলবায়ু সম্মেলনে যুব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুতে ইউএনএফসিসিসির অফিসিয়াল ফোরাম ইয়াঙ্গু বিশ্বের ১৪৯টি দেশের তরুণদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রস্তাবিত দাবিগুলো ১৫টি বিষয়বস্তুর আলোকে সম্মেলনে তুলে ধরেন। এছাড়া একই দিনে যুবক এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের নিয়ে ‘পাসিং দ্য বাটন’ শিরোনামে আয়োজিত প্রথম দুটি গোলটেবিল বৈঠকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশগ্রহণকারী যুব জলবায়ু কর্মী এবং অনুশীলনকারীরা অ্যাডাপটেশন, রেজিলিয়েন্স এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন রোধে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের নেতৃত্বাধীন পদক্ষেপগুলোও একটি প্যানেল আলোচনায় তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জলসম্পদ এবং অবকাঠামোর ক্ষতির বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পায়। এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের ক্ষয়ক্ষতি এবং এ থেকে উত্তরণে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান বাস্তবায়নে ২৩০ বিলিয়ন দাবি করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ধনী দেশ, বেসরকারি সংস্থাসহ সবাইকে অর্থ তহবিল জোগাতে এগিয়ে আসতে হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা।
সম্মেলনের ষষ্ঠ দিনকে (১১ নভেম্বর) জাতিসংঘ, কপ২৭-এর ডি-কার্বনাইজেশন দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেছে। এ দিনে মূলত বিভিন্ন সেক্টর থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে আলোচনা করা হয়। পাওয়ার সেক্টর, সড়ক পরিবহন, স্টিল শিল্প, হাইড্রোজেন জ্বালানি এবং কৃষি এ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আগামী ১২ মাসের মধ্যে অর্থাৎ কপ২৮-এর আগে ডিকার্বনাইজেশন বা কার্বনমুক্তকরণকে গতিশীল করতে ২৫টি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। এ প্ল্যানের মাধ্যমে সস্তায় ও সহজলভ্যভাবে ক্লিন এনার্জি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে বলে বিশ্বনেতারা আশাবাদী। এছাড়া টেকনোলজি ট্রান্সফার, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এবং ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে কীভাবে তেল এবং গ্যাস ইন্ডাস্ট্রি থেকে মানবসৃষ্ট মিথেন নিঃসরণ কমানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সবাই একমত হয়েছে, আমাদের এখন কম কার্বন নির্গমন করে অথবা প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করে এমন স্টিল কারখানা এবং হাইড্রোজেনচালিত শক্তি ও টেকসই ব্যাটারি শিল্পের প্রয়োজন। এজন্য বিশ্বস্ততা এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিলিয়ন পাউন্ডের ইনভেস্টমেন্ট দরকার। কমপক্ষে ৫০টি বড় আকারের প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করে এমন শিল্প-কারখানা এবং কমপক্ষে ১০০টি হাইড্রোজেন শক্তি দ্বারা পরিচালিত অঞ্চল গঠন করতে হবে। পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০৪০ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহন হতে দূষণ রোধ করার জন্য ২০৪০ সালের মধ্যে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সার কৃষি উৎপাদনের অপরিহার্য একটি উপাদান, কিন্তু কৃষিকাজে ব্যবহূত রাসায়নিক সার ও বর্জ্য থেকে প্রচুর নাইট্রাস অক্সাইড উৎপাদন হয়। ইউএসইপিএর তথ্যমতে ২০২০ সালে আমেরিকায় মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের মোট পরিমাণের ৭ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল নাইট্রাস অক্সাইড। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ অবক্ষয় রোধে আমাদের কৃষি খাতে প্রভূত গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। বিশ্বের ৭ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়ে থাকে সিমেন্ট শিল্প থেকে। এ শিল্পের কাঁচামাল থেকে খাদ ও উদ্বায়ী পদার্থ দূর করতে উচ্চতাপ প্রয়োগে প্রচুর কার্বন নিঃসরণ হয়ে থাকে, কিন্তু অপরিহার্য এ শিল্প বন্ধ করা যাবে না। তাই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে এ শিল্পগুলো থেকে যাতে কার্বন নিঃসরণ না হয় সে বিষয়ে বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। শিল্পে কার্বনমুক্তকরণের জন্য কপ২৬-এ ফাস্ট মুভার্স কোয়ালিশন গঠন করা হয়েছিল, তারা এখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদের অন্তর্ভুক্ত নতুন ১০টি করপোরেট কোম্পানিগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০ শতাংশ প্রায় শূন্য কার্বন নিঃসরণ করে এমন সিমেন্ট ও কংক্রিট ক্রয় করবে। এক্ষেত্রে কপ২৭-এর এজেন্ডা বাস্তবায়নে জি সেভেনে গঠিত ইউরোপিয়ান কমিশন, ভারত, মিসর, মরক্কোসহ অন্যান্য দেশ, নেতৃত্ব স্থানীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং সরকারি মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিল্প খাতে অর্থায়ন এবং নতুন উদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে।
সম্মেলনের সপ্তম দিনকে (১২ নভেম্বর) অভিযোজন এবং কৃষি দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং মূলত অভিযোজন ও কৃষির ওপর মোট ১২টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম অধিবেশনে কপ২৭-এর FAST উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এ উদ্যোগে লক্ষ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে কৃষি এবং খাদ্যের জন্য আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় অধিবেশনে মাল্টিস্টেকহোল্ডার ও মাল্টিসেক্টরাল উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ উদ্যোগটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানব স্বাস্থ্য ও পুষ্টিঝুঁকি কমাবে। অন্যদিকে ক্লাইমেট রেসপন্স ফর সাস্টেইনিং পিস উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন আরো কীভাবে বাড়ানো যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোয় খরা এবং বন্যার ক্ষতি কমানোর জন্য পূর্বাভাস প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তথ্য বিশ্লেষণ বৃদ্ধি, জলবায়ু স্মার্ট কৃষি এবং এক্ষেত্রে বেসরকারি ও বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানিগুলো কীভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বর্তমান খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির অবস্থা, কীভাবে ‘কোরোনিভিয়া জয়েন ওয়ার্ক অন এগ্রিকালচার’ বাস্তবায়ন করা যায় তার ওপর বিশেষ আলোচনা করা হয়। দিনের শেষে অর্থাৎ ১২তম অধিবেশনে মিসর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত কীভাবে কৃষি সেক্টর বাড়ানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তা আলোচনায় গুরুত্ব পায়।
পরিশেষে বলা যায়, শক্তিশালী উপস্থাপনা, নিঃশব্দ প্রতিবাদ এবং সামান্য নগদপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে শেষ হলো কপ২৭।