by Team CAPS, 0 Comments
মশা নামের ক্ষুদ্র পতঙ্গটি বিশ্ববাসীর জন্য আতঙ্ক। পতঙ্গটি আকারে ছোট হলেও ছড়াতে পারে নানা ধরনের মারাত্মক সংক্রামক রোগ। মশার মাধ্যমে সাধারণত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ইত্যাদি ভাইরাসজনিত রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে।স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ রোগগুলোর ভয়াবহতা এত বেশি যে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১৬ জনের মৃত্যু হয় এবং জানুয়ারি থেকে ৫ অক্টোবর ২০১৮ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৪৪৯ জন।
মশার উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষ নানা ধরনের রাসায়নিক বা যান্ত্রিক উপায় অবলম্বন করে থাকে। সাধারণত মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য মশার কয়েল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। মশার কয়েলের ধোঁয়া মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
মালয়েশিয়ার চেস্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুযায়ী, একটি মশার কয়েল ১০০টি সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত করে এবং নিয়মিত কয়েল ব্যবহার ফুসফুসে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ তৈরি করে। মশার কয়েলের ধোঁয়া শ্বাসকষ্ট, নাক-মুখ জ্বালাপোড়া করা, নাক বন্ধ হয়ে আসা, হাঁচির উদ্রেক সৃষ্টি ইত্যাদির জন্য দায়ী।
আবার এ ধোঁয়া বায়ু দূষণের জন্যও দায়ী। যদি প্রাকৃতিক উপায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকবে; অন্যদিকে আমরা বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাবো। এ ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ, মাছ ও কিছু দেশীয় জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
উদ্ভিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ : মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য গাঁদা, তুলসী, পুদিনা, ব্যাজল, সিট্রোনেলা, লেমন গ্রাস, ল্যাভেন্ডার ইত্যাদি উদ্ভিদ খুবই কার্যকর। সাধারণত আমরা এ উদ্ভিদগুলো সৌন্দর্যবর্ধক অথবা ওষুধি হিসেবে ব্যবহার করে থাকি।
এর মধ্যে গাঁদাফুল গাছ আমাদের দেশে খুবই সহজলভ্য ও এই ফুলের মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণের কারণে এটি সবার কাছে প্রিয়। গাঁদাফুলের রেণু ও পাপড়ি থেকে নিঃসৃত বিশেষ গন্ধ মশার জন্য অসহনীয়। ঠাণ্ডাজনিত সর্দির প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য অনেকের বাড়িতে থাকে একটি তুলসী গাছ। ওষুধি গুণাগুণ ছাড়াও মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে তুলসী গাছ।
২০০৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পুদিনা তেল মশার লার্ভার জন্য খুব বিষাক্ত। এটি মশার ডিম সরবরাহের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এর তীব্র গন্ধ মশা দূরীকরণে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। পুদিনা পাতা আমরা সালাদ হিসেবে খেয়ে থাকি, কিন্তু এটি মশা দূরে রাখতেও ব্যবহার করা যায়।
ব্যাজল হল পুদিনা বা ধনিয়াপাতার মতোই সুগন্ধযুক্ত লতাগুল্ম। ব্যাজলের পাতা খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়, তবে এ গাছ মশা তাড়ানোর কাজও করে থাকে। ব্যাজলের গন্ধ মশারা সহ্য করতে পারে না।
সিট্রোনেলা এক ধরনের ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। এটি পাঁচ থেকে ছয় ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়। এ ঘাস থেঁতলে তেল বা রস বের করে পানিতে মিশিয়ে ঘর মুছলে মশার উপদ্রব কমে আসে। ল্যাভেন্ডার এক জাতীয় সুগন্ধি উদ্ভিদ। এতে বেগুনি ফুল ধরে, যার সুগন্ধ মশার অপছন্দ।
উল্লিখিত উদ্ভিদগুলো ছোট আকারের, তাই সহজেই ঘরের আঙ্গিনায়, ফুল বাগানে, বড় বাগানের ধারে, বারান্দা কিংবা জানালার পাশে টবে লাগানো যায়। মনে রাখতে হবে, ব্যাজল গাছের জন্য প্রয়োজন প্রচুর সূর্যের আলো ও পানি। তবে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না।
পানি নিষ্কাশনের উত্তম ব্যবস্থা থাকতে হবে। সিট্রোনেলা গাছেরও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো রাখতে হবে। তবে সবুজ পুদিনা গাছকে সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখতে হবে।
এ গাছগুলো যদি টবে অন্যান্য গাছের সঙ্গে লাগানো হয় তবে ভুলবশত টবের গোড়ার জলকান্দায় যে পানি জমে থাকে সেখানে আর মশার বংশবিস্তার হবে না।
এর ফলে একদিকে যেমন মশার উপদ্রব কমবে, তেমনি ঘর বা আমাদের চারপাশের পরিবেশও সুন্দর থাকবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ উদ্ভিদগুলো মশা নিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মাছ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ : মশা নিয়ন্ত্রণে গাপ্পি মাছ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এ মাছ অনেকটা ছোট আকৃতির। কম অক্সিজেনযুক্ত ও অপেক্ষাকৃত দূষিত জলেও এদের বেঁচে থাকতে কোনো অসুবিধা হয় না। সাধারণভাবে এ মাছের গড় আয়ু ৩-৪ বছর।
মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, প্রতি ঘণ্টায় একটি মাছ ২০০ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলতে পারে। এ মাছ ডোবা-নালা, ড্রেন, পুকুর কিংবা সুইমিংপুল বা অ্যাকুরিয়ামের মধ্যে চাষ করলে মশার উপদ্রব কমে যাবে। গাপ্পি মাছ মশার জীবনদশার সব অবস্থাতেই (ডিম, শুক, মুক-কীট এবং পূর্ণাঙ্গ মশা) ভক্ষণ করতে পারে।
এই মাছ খুব সহজেই কম খরচে চাষ করা যায়। ঘরের মধ্যে প্লাস্টিকের ড্রামে বিশেষ পদ্ধতিতে গাপ্পি মাছ চাষ করা যায়। এরই মধ্যে ভারত, মালয়েশিয়া, কোরিয়ায় মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য গাপ্পি মাছের ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং তারা ভালো ফলাফল লাভ করছে। গাপ্পি মাছ দ্বারা মশা নিয়ন্ত্রণে পরিবেশের ওপর কোনো প্রভাব নেই।
সুতরাং আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ২০১৭ সালের ৭ অক্টোবর মেয়র মোহাম্মদ সাইদ খোকনকে সঙ্গে নিয়ে মশার বংশবিস্তার রোধে আনুষ্ঠানিকভাবে গাপ্পি মাছ অবমুক্ত করে।
দেশীয় জ্ঞানের মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ : শুধু বিভিন্ন গাছপালা কিংবা মাছ দিয়ে নয়, এমন আরও কিছু পদ্ধতি আছে- যেগুলো মশা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ পদ্ধতিগুলো খুঁজে পাওয়া যায় হাজার বছর ধরে অর্জিত আমাদের দেশীয় জ্ঞানের মধ্যে।
এমন এক সময় ছিল, যখন মানুষ নিজের অজান্তে এমন কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে; যার কারণে তারা মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেত। এমন একটি কৌশল হল সন্ধ্যাবেলা ঘরে ধূপ দেয়া। হয়তো কেউ সুগন্ধির জন্য, কেউবা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ঘরে ধূপের ধোঁয়া দিত। ধূপের ধোঁয়ার গন্ধে মশা ঘরে প্রবেশ করে না।
অনেকে ঘরের মধ্যে নিমগাছের ডাল রেখে দেয়, আবার কখনও কখনও নিমগাছের ডাল পোড়ায়। নিমের ডাল ঘরে রাখলে কিংবা নিমের ডাল পোড়ালে মশার বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়; ফলে মশার উৎপাত কমে আসে। আগেকার দিনে মশা থেকে মুক্তির জন্য বদ্ধঘরে কর্পূর পোড়ানো হতো।
কর্পূর মশা তাড়াতে অত্যন্ত কার্যকর একটি উপাদান। এটি মশা তাড়াতে দীর্ঘ সময় কাজ করে। গ্রামীণ জনগণ খোসা ছাড়া রসুন বা রসুনমিশ্রিত পানি মশার বিষাক্ততা থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করত। আগে মানুষ রাসায়নিক বা যান্ত্রিক বিষয়ের ওপর কম নির্ভর করত।
প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের রক্ষা করত। আমাদেরও উচিত মশা নিয়ন্ত্রণে এসব জ্ঞান প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে মশা নিধনের উপায় খুঁজে বের করা যেতে পারে।
বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমেও মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। শখের বশে করা বাগান কিংবা ফুলের টবে পানি জমে সেখানে মশার বংশবিস্তার হচ্ছে কিনা, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।
ঘরের ভেতরের পরিবেশ সবসময় সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। সঠিক নিয়মে নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই সম্পূর্ণভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।