পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর জন্য বৃষ্টিপাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদিও পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ ভূপৃষ্ঠের পানি দিয়ে আবৃত। পৃথিবীর মোট পানির প্রায় ৯৭ ভাগ সমুদ্রের পানি, যা আমরা সরাসরি পান করতে, কৃষি কাজ কিংবা গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করতে পারি না। তাই নিরাপদ পানির অন্যতম উৎস বৃষ্টির পানি। এ কারণেই বৃষ্টির পানি ভূপৃষ্ঠস্থ, ভূগর্ভস্থ ও জলজ প্রাণীর প্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতকে আশীর্বাদ বলে মনে করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাত ও বৃষ্টির সঙ্গে শিলার পতন মানুষের ভীত ও উদ্বিগ্ন হওয়ার বিশেষ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বরফখণ্ডের পতনকে শিলাবৃষ্টি বলে। গত ৩১ মার্চ হঠাৎ বাংলাদেশের সর্বত্র ভারি বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ২০টি জেলায় এই আকস্মিক বৃষ্টিপাত হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তরাংশের রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, বগুড়া ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলার মানুষ এর বেশি ভুক্তভোগী। এ ছাড়া সিলেট, মাগুরা, যশোর, কুষ্টিয়া, শেরপুর, ভৈরব, নরসিংদী ও মানিকগঞ্জের মানুষও এই দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। গত ৪ এপ্রিল ঢাকার গুলশান, বসুন্ধরা, বারিধারাসহ বেশ কয়েক স্থানে এরূপ বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং গত পহেলা বৈশাখেও ঢাকার বেশ কিছু জায়গায় শিলাবৃষ্টি হয়েছে। শিলাবৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়; কিন্তু সম্প্রতি যে ধরনের শিলাবৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের বিস্মিত করছে। কারণ এত বড় বরফখণ্ড বা শিলার টুকরো নিকট অতীতে কোনো বৃষ্টিপাতের সঙ্গে পড়েনি। কিছু বড় বরফখণ্ড বা শিলার টুকরোর ওজন এক কেজিরও বেশি ছিল, যা খুবই অস্বাভাবিক। অনেক বয়স্ক মানুষ বলেছেন, তারা তাদের জীবনকালে এত বড় আকারের বরফখণ্ড দেখেননি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিশ্বব্যাপী একটি বড় সমস্যা এবং এটি পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ। এমনকি এটি স্থানভেদে আবহাওয়ার প্যাটার্নের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে, যা বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী। জলীয় বাষ্প বৃদ্ধির হার Clausius-Clapeyron-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ বাতাসে প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ৭ শতাংশ আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়। এর মানে উষ্ণ বায়ু বেশি জলীয় বাষ্প ধারণ করে। বস্তুত বায়ুতে থাকা আর্দ্রতা তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ক্লিম্যাটোভো ডাটাবেসের মতে, ২০১৪ সালের মার্চ মাসে দেশের গড় তাপমাত্রা ছিল ২৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তবে ২০১৮ সালে তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে দাঁড়িয়েছে। এটা অনুমান করা যায় যে, বর্তমানে মার্চ মাসের গড় তাপমাত্রার হার বৃদ্ধির কারণে অধিক শিলাবৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের শেষদিকে শিলাবৃষ্টি হয়ে থাকে। বেশিরভাগ সময় শিলাবৃষ্টি ঝড় ও বজ্রপাতের সঙ্গে হয়ে থাকে, যা এর শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের উদ্ধৃতি দিয়ে গত ১৬ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলো এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে এপ্রিল মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত, কালবৈশাখী, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড় এবং অঞ্চলভেদে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের এক অশনিসংকেত।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে শিলাবৃষ্টির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া শিলাবৃষ্টি শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়; এটি এক প্রকার দুর্যোগ এবং এর নানাবিধ প্রভাব রয়েছে। সাধারণত শিলা বা বরফখণ্ডের আকার ২৫ থেকে ১৫০ মিলিমিটার হয়ে থাকে; কিন্তু এই আকার থেকে বড় হলে এটি মারাত্মক ক্ষতিকারক। এমনকি মরণঘাতীও হতে পারে। অনেক গ্রামীণ এলাকায় মানুষ তাদের বাড়িটি টিনের চাল দিয়ে তৈরি করেন। ভারি শিলাবৃষ্টির ফলে এই টিনের চালে গর্ত তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ফসলের জমিগুলোও এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি মানুষ ও গবাদিপশুর জীবনও বিপন্ন হয়েছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই দুর্ঘটনায় ৮ জনের মৃত্যু হয় ও প্রায় ৩শ’ মানুষ মারাত্মক আহত হয়েছে। এক লাখেরও বেশি আম, লিচু ও অন্যান্য ফলের গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় এক লাখ হেক্টর ধান, আলু, টমেটো, রসুন, তরমুজ, ফুটি ও অন্যান্য ফসলের ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহর এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও অন্যান্য পরিবহনের কাচ ভেঙে গেছে। বিভিন্ন জেলায় দুই শতাধিক ইটভাটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শিলাবৃষ্টির সময় জানমাল রক্ষা করতে খোলা স্থানে চলাচলে বিরত রাখার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন হতে হবে। বৃষ্টিপাতের সময় ও বৃষ্টি থামার পরপরই বৈদ্যুতিক তার ও সুইচে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু কৃষি জমি রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। গ্রিনহাউস প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো তাদের খামার-জমিকে শিলাবৃষ্টির আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারলেও আমাদের দেশে শিলাবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে কোনো প্রকার প্রযুক্তি নেই। তাই এটা জরুরি যে, শিলাবৃষ্টির হাত থেকে কৃষি অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে আমাদের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। যদি একবার আমাদের কৃষি ব্যবস্থার পতন হয়, তবে অর্থনীতি অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই এ বিষয়ে এখনই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের সময় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরন, আচরণ, গতিবিধি উপযুক্ত গবেষণার মাধ্যমে নির্ণয় করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।