by Team CAPS, 0 Comments
আজ বিশ্ব প্রাণী দিবস। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রাণিজগতের কল্যাণের জন্য বার্তা পৌঁছে দেওয়া এবং প্রাণীকল্যাণ আন্দোলনকে যূথবদ্ধ করা। জীববৈচিত্র্যের একাংশ জুড়ে রয়েছে প্রাণিকুল। প্রাণীরা পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। প্রতিটি প্রাণী তার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জীবজগৎ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক প্রাণী জীবনযুদ্ধ করে প্রাণী ও খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষা করে চলেছে।
হেনরিক জিম্মারমেন নামে একজন জার্মান লেখক ১৯২৫ সালের ২৪ মার্চ জার্মানির বার্লিন প্যালেসে প্রথম এই দিবস উদযাপন করেন। অনুষ্ঠানে সাড়ে চার হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারী ছিল। এরপর ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে ‘আন্তর্জাতিক প্রাণী সুরক্ষা কংগ্রেস’-এ তার উপস্থাপন করা প্রস্তাবমতে ৪ অক্টোবর ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দিবসটি বিভিন্নভাবে বাংলাদেশেও পালিত হয়।
এককোষী থেকে শুরু করে নানা প্রজাতির বহুকোষী প্রাণী পৃথিবীতে বিদ্যমান। প্রাণীরা সাধারণত জীবন ধারণ করার জন্য অন্য জীবের ওপর নির্ভর হয়ে থাকে। কখনও তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আবার কখনও প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বিলুপ্ত হওয়ার পথে যে প্রাণীগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হাতি।
বাংলাদেশে একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন বা সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিশাল পরিবার ছিল। বন উজাড় এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বাঘগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং চিড়িয়াখানায় থাকা বাঘগুলোও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। মাংস বাঘের প্রধান খাবার। বাঘের শিকার উপযোগী বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বর্তমানে লক্ষ্যণীয়ভাবে কমে যাচ্ছে, ফলে বনে খাদ্যের অভাবে এরা লোকালয়ে প্রবেশ করছে। মানুষ লোকালয়ে আসা বাঘগুলোকে মেরে ফেলছে এবং এদের শরীরের অংশগুলো বিক্রি করছে। শুধু তাই নয়, বনে গিয়েও মানুষ বাঘ শিকার করছে। বন বিভাগ পরিচালিত বাঘশুমারি অনুযায়ী ২০০৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। ২০১৫ সালের শুমারিতে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় মাত্র ১০৫টি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আটটি বাঘ চোরা-শিকারিদের হাতে নিহত হয়েছে, লোকালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৪৩টি বাঘ, অসুস্থ হয়ে দুটি ও স্বাভাবিকভাবে আটটি বাঘ মারা যায়। এভাবে বাঘের সংখ্যা কমে গেলে অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনে বাঘ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অপরদিকে হাতি একটি বিশাল দেহবিশিষ্ট প্রাণী। আন্তর্জাতিক বাজারে অবৈধভাবে হাতির দাঁত কেনাবেচা একটি লাভজনক ব্যবসা। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বন উজাড় করে হাতির বাসস্থান ধ্বংস করে ফেলছে মানুষ। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন পরিচালিত হাতি সমীক্ষা ২০১৬ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২১০ থেকে ৩৩০টি হাতি ছিল। তাছাড়া ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমানা দিয়ে চলাচলকারী অভিবাসী হাতির সংখ্যা ৭৯ থেকে ১০৭টি। পোষা হাতির সংখ্যা ছিল ৯৬টি। কক্সবাজারসহ চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যান্য অঞ্চলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে ওই অঞ্চলে হাতিগুলো বিপদের মুখে। বন বিভাগের তথ্যমতে, রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে বন্য হাতির ১২টি চলাচল পথ বন্ধ হয়েছে এবং ২২টি জলাধার ধ্বংসের পথে। এর ফলে ৬৭টি হাতি আটকা পড়েছে এবং তীব্র খাদ্য ও পানি সংকটে ভুগছে।
বর্তমানে শুধু যে বন্যপ্রাণীরা নিরাপত্তাহীনতায়, তা নয়। লোকালয়ে থাকা কিংবা পোষা প্রাণীরা বিভিন্নভাবে নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) শহরের ৩০ হাজার কুকুরকে অন্য জেলায় স্থানান্তরের কার্যক্রম ঘোষণা করেছে। পরিবেশবিদ ও কুকুরপ্রেমীরা এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কুকুরগুলো ময়লা-আবর্জনা খেয়ে, রাস্তা পরিস্কার রেখে মানুষকে সহায়তা করে এবং তারা পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে। কুকুর নীরব প্রহরীর মতো মানুষকে নিরাপত্তাও দিয়ে আসছে। অতীতে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন আদিম পদ্ধতিতে কুকুর নিধন করত। ২০১২ সালে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছিলেন যে, কুকুর নির্বিচারে হত্যা অমানবিক। বিকল্প হিসেবে সরকার কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালের প্রাণী কল্যাণ আইনের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মালিক ব্যতীত কোনো প্রাণী হত্যা বা অপসারণ করা যাবে না।
এছাড়া স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন’ জারি করেন। তার আমলেই ১৯৭৪ সালে আইনটি সংশোধন হয়। বঙ্গবন্ধু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কতটা আন্তরিক ছিলেন, সদ্য স্বাধীন দেশে এ বিষয়ে তার মনোযোগ দেখে বোঝা যায়।
মনে রাখতে হবে- বন বাঁচলে বাঁচবে প্রাণী, বাঁচবে মানুষ ও প্রকৃতি। বন্যপ্রাণী বিপন্নকারী ও পাচারকারীদের অবশ্যই চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। তাই ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’ উপলক্ষে আহ্বান- প্রাণীকে ভালোবাসুন, মূল্যবান বন্যপ্রাণী-সংক্রান্ত অপরাধ দমনে এগিয়ে আসুন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করুন। আমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য প্রাণীর প্রতি এই ভালোবাসা নিশ্চিত করতে হবে।
