পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায়, ভৌত পরিবেশের সহনক্ষমতা-বহির্ভূত অপেক্ষাকৃত উচ্চ-তীব্রতাসম্পন্ন শব্দের উপস্থিতিতে জীব-পরিবেশ তথা মানুষের ওপর যে অসংশোধনযোগ্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়, তাতেই সৃষ্টি হয় ‘শব্দদূষণ’। মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নামছে নতুন গাড়ি। গাড়ির চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শব্দদূষণ। দিনে দিনে শব্দদূষণ এক মহামারী আকার ধারণ করেছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) শব্দদূষণ বন্ধে আদালতে একটি রিট পিটিশন করে। উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন ও বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যে কোনো ধরনের হর্ন সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং গাড়িতে বাল্ক্ব-হর্ন সংযোজনের নির্দেশ দেন। এর পরও আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব শহরই নীরব ঘাতক শব্দদূষণের কবলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেল শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে এবং ১০০ ডেসিবেল শব্দে চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। অথচ রাজধানী ঢাকায় ১০৭ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। আসলে দেশে অসংখ্য সমস্যা দৃশ্যমান। নীরব ঘাতক এই শব্দদূষণ নিয়ে কেউ চিন্তা করছে না। আবার বেশিরভাগ লোক না বুঝেই এমন কাজ করে। রাস্তায় অযথা হর্ন বা মাইক বাজিয়ে ক্যাম্পেইন, ভিক্ষা, জোরে আওয়াজ দিয়ে গান শোনা, শব্দ করে হাঁটা এবং অতি বিশেষ ব্যক্তিদের জন্মদিনে মাইকে গান ও বক্তৃতার রেকর্ড বাজানো- এমন ছোটখাটো কিছু দূষণ, যা আমরা সহজে ত্যাগ করতে পারি। কিন্তু আমরা নিজেরাই এ ব্যাপারে সচেতন নই। যেসব আইন আছে, তার প্রয়োগ করি না এবং কখনও কখনও নিজেও ভঙ্গ করে বসি।
উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে বাস করতে করতে মানুষের স্বভাব ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এ নিয়ে অনেক সময় পারিবারিক বিপর্যয়ও নেমে আসে। একজন অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোক প্রায়ই তার পাশের বাড়ির টিভি থেকে ভেসে আসা অস্ট্রেলীয় অপেরার ‘থিম সং’-এর উচ্চ শব্দে বিরক্ত হতেন। ক্রমেই সেই সঙ্গীত তার কাছে এমন যন্ত্রণায় রূপান্তরিত হলো, একদিন তা সহ্য করতে না পেরে তিনি তার প্রতিবেশীকে খুন করে বসলেন। ১৯৯২ সালের এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাচ্ছে না। কারণ, ‘রাইট টু পিস অ্যান্ড কোয়ায়েট ক্যাম্পেইন’-এর মতে, এই শব্দদূষণকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে প্রতি বছর অন্তত পাঁচজন খুন হয়। ভারতের কানপুরে এ ধরনের এক হত্যাকাণ্ড ঘটে। রেল কলোনির ছাদের ওপর ক্রীড়ারত কয়েক শিশুর কোলাহলে দুপুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় এক কনস্টেবল দুটি বাচ্চাকে ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে। এতে একজনের মৃত্যু হয়, আরেকজন গুরুতর আহত হয়। আমেরিকায় এমন এক ঘটনায় ক্রীড়ারত শিশুর ওপর বিরক্ত হয়ে গুলি করে বসে এক প্রতিবেশী। আসলে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত শব্দ যদি আমরা দিনের পর দিন শুনতে বাধ্য হই, তাহলে সেই শব্দের দূষণও অন্যান্য পরিবেশ দূষণের মতো মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। আমাদের শরীর ও মনের মাঝে যে এসব তীব্র প্রভাব ফেলে, উল্লিখিত ঘটনাই তার সাক্ষ্য বহন করে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে বেশ কিছু আইন ও বিধিমালা রয়েছে। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতায় তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। শব্দদূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ১৯৯৭ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় শহরাঞ্চলকে ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাতের জন্য শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর পুলিশ অর্ডিন্যান্স-১৯৭৮-এর ২৫ অনুচ্ছেদের ‘ছ’ উপানুচ্ছেদে বলা আছে- ‘রাস্তায় বা জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে হর্ন, উচ্চস্বরে সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, ঢাক পেটানো ইত্যাদির মাধ্যমে জনসাধারণ অথবা নিকটবর্তী বাসিন্দাদের প্রতিবন্ধকতা ও বিরক্তি সৃষ্টি করতে পারে এমন কাজের জন্য পুলিশ কমিশনার তাৎক্ষণিক গ্রেফতারসহ শাস্তি প্রদান করতে পারেন।
এর পর ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা হলো ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল। এই বিধির আওতায় স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং অফিস-আদালতকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের চতুর্দিকে ১০০ মিটারের ভেতর কোনো ধরনের হর্ন বাজানো যাবে না। আরও বলা হয়েছে, কোনো উৎসব কিংবা সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে লাউডস্পিকার অথবা কোনো যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করতে হলে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি লাগবে। এসব কার্যক্রম সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টার বেশি হবে না। এর পাশাপাশি রাত ১০টার পর কোনোভাবেই শব্দদূষণকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩’র ১৪০ ধারায় অপ্রয়োজনে হর্ন বাজালে ১০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দেশে এসব বিধি মানা হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ওয়াক ফর বেটার বাংলাদেশের এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার কোনো পাবলিক স্থানের শব্দের মানমাত্রা ৬০-এর নিচে নেই। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শব্দদূষণের মাত্রা মেপে জানায়, রাজধানীর নীরব এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা ৭৫-৯৭ ডেসিবেল। আবাসিক এলাকায়ও এটা সহনীয় মাত্রার দুই গুণ। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশি।
মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯-এর আওতায় শব্দদূষণ বিধিমালাটি অন্তর্ভুক্ত না থাকায় এ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগও নেই। মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের সুবিধার্থে মোবাইল কোর্ট আইনে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরে পরিচালিত এনফোর্সমেন্ট অভিযানে ১০৩টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক কোটি ৮৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। এর মধ্যে এক কোটি ৭৭ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। বর্তমানে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচি’র আওতায় শব্দদূষণ রোধে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
‘সুস্বাস্থ্যের জন্য শ্রবণশক্তি রক্ষা’- এ স্লোগান সামনে রেখে প্রতি বছর ৩ মার্চ শব্দ সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। এ উপলক্ষে ‘লীগ ফর দ্য হার্ড অব হিয়ারিং’ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। তারা এই দিনে ১ মিনিট নিঃশব্দে থাকে। এ ছাড়া বিনা মূল্যে কানের পরীক্ষা এবং শোনার যন্ত্রও দিয়ে থাকে।
আস্তে আস্তে কথা বলার মধ্যে যে মাধুর্য ছিল, তা আমরা হারাতে বসেছি। অন্তরঙ্গ আলাপ হয়তো ভবিষ্যতে হবে বিরাট হাঁকডাক করে। উৎকট শব্দে আজ আমরা পরিশ্রান্ত। আমরা যারা শব্দদূষণের শিকার ও স্রষ্টা, তারা সবাই এ দেশের নাগরিক। মহামারী রূপ ধারণ করার পর নকল বন্ধ হয়েছে, পলিথিন বন্ধ হয়েছে। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে আসুন আমরা সবাই মিলে সচেতন হই। আমরা সবাই দায়িত্বশীল হলে শব্দদূষণ প্রতিরোধ সম্ভব। আসুন সবাই শপথ করি, শব্দদূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ি।
