by Team CAPS, 0 Comments
নির্বাচনকে ঘিরে উৎসাহ আমেজ বইছে চারদিকে, এরই সঙ্গে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। কিছু ব্যাপার সর্বদা আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়, আবার কিছু ব্যাপার আমরা যেমন করে ভাবি ঠিক তার উল্টা হয়ে যায়।
নির্বাচন সামনে রেখে জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে পোস্টার ছাপাচ্ছেন। কখনও দলের কর্মীরা প্রিয় প্রতিনিধির সুনাম নিজেরাই মাইক দিয়ে প্রচার করছে, কখনও নেতা নিজেই নির্বাচন-পরবর্তী উন্নয়ন কাজের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
নির্বাচনকে ঘিরে হেঁটে মিছিল করা যেন ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি যোগ হয়েছে মোটরসাইকেল ও গাড়ি দিয়ে শোডাউন করা। এসব কার্যক্রম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবেশ দূষণ করে থাকে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে মোট প্রার্থী সংখ্যা আসন সংখ্যার ৬ গুণেরও বেশি। সংবাদমাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্যমতে, এবারের নির্বাচনে মোট প্রার্থী সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮৪১।
‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা ২০০৮’-এর ‘বিধি-৭ (পোস্টার, লিফলেট, বা হ্যান্ডবিল ব্যবহার সংক্রান্ত বাধা-নিষেধ) এর উপবিধি-৩’ অনুযায়ী ‘কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃতব্য পোস্টার সাদা-কালো রঙের হইতে হইবে এবং উহার আয়তন ২৩ ইঞ্চি ১৮ ইঞ্চি এর অধিক হইতে পারিবে না এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পোস্টারে তাহার প্রতীক ও নিজের ছবি ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির ছবি বা প্রতীক ছাপাইতে পারিবে না।’
কিন্তু প্রার্থী কী পরিমাণ (সংখ্যায়) পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল মুদ্রণ করতে পারবে এবং কাগজ কত জিএসএমের হবে (প্রতি বর্গমিটার কাগজের গ্রাম ওজন) তা বিধি-৭ এ উল্লেখ নেই। ২৯ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির ঢাকা অঞ্চলে ৩০০-র বেশি সদস্য বা ছাপাখানা রয়েছে।
বিগত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) এসব ছাপাখানা থেকে প্রায় ৩ কোটির বেশি পোস্টার ছাপানো হয়েছিল, যার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকা।
এ বিপুল পরিমাণ পোস্টারের শুধু আর্থিক মূল্য বিবেচনা করলেই হবে না, বিবেচনা করতে হবে পরিবেশগত অবস্থা। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ একটি হিসাব করে দেখেছে, ২৩ ইঞ্চি ১৮ ইঞ্চি আকারের ৮০ জিএসএমের ৩ কোটি পোস্টারের কাগজ তৈরির জন্য ৮০৩০টি গাছ প্রয়োজন।
কাগজের উৎপাদন ও গাছের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য; অপরদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুস্থ ও নির্মল রাখতেও গাছের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকান এনসি স্টেট ইউনিভার্সিটির হর্টিকালচার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি গাছ বছরে প্রায় ২২ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশকে নির্মল করে। যত বেশি কাগজের ব্যবহার, তত বেশি গাছের মৃত্যু।
আমরা যে শুধু কাগজ ব্যবহারের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করছি তা নয়, আমরা নির্বাচনী প্রচারণার জন্য গাছকে অসুস্থও করে তুলছি।
‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা ২০০৮’-এর ‘বিধি-৭ (পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ব্যবহার সংক্রান্ত বাধা-নিষেধ) এর উপবিধি-১ অনুযায়ী, ‘কোনো প্রার্থী কিংবা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নিম্নে উল্লেখিত স্থান বা যানবাহনে কোনো ধরনের পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল লাগাইতে পারিবেন না, যেমন- (ক) ‘সিটি কর্পোরেশন এবং পৌর এলাকায় অবস্থিত দালান, দেয়াল, গাছ, বেড়া, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন খুঁটি বা অন্য কোনো দণ্ডায়মান বস্তুতে।’
এই বিধির শেষ অংশে উল্লেখ রয়েছে ‘তবে শর্ত থাকে যে, দেশের যে কোনো স্থানে পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ঝুলাইতে বা টাঙাইতে পারিবে।’
এর ফলে প্রার্থীরা তাদের পোস্টার ঝুলাতে গাছের গায়ে অসংখ্য পেরেক বা তারকাঁটা দিয়ে দড়ি সংযোজন করছেন, আবার দীর্ঘস্থায়ী করে পোস্টার ঝুলাতে পাটের দড়ির পরিবর্তে জিআই তারও ব্যবহার করছেন।
গাছের দেহে এসব বাহ্যিক জিনিসের উপস্থিতির কারণে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়। অপরদিকে বৃষ্টি বা আর্দ্রতার প্রভাব থেকে পোস্টার রক্ষা করতে পোস্টারের ওপর পলি (প্লাস্টিক) লেমিনেশন করা হয়। কাগজ পচনশীল হলেও পলি (প্লাস্টিক) পচনশীল নয়।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ অপর একটি হিসাব করে দেখে যে, ২৩ ইঞ্চি ১৮ ইঞ্চি আকারের প্রতিটি পোস্টার লেমিনেশন করতে ৯ গ্রাম পলিথিন ব্যবহার করা হয়।
এ হিসাব অনুযায়ী ৩ কোটি পোস্টারের জন্য প্রায় ৩০০ টন পলিথিন দরকার। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে পোস্টার অপসারণের জন্য নির্বাচন বিধিমালায় কোনো নির্দেশনা নেই এবং পরবর্তী সময়ে এ পোস্টারগুলো রাস্তায় ছিঁড়ে পড়ে থাকে এবং নালা-নর্দমা আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।
অনেক সময় পোস্টার নষ্ট করতে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যা পরিবেশের আরও মারাত্মক ক্ষতি করে।
জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের প্রচারণা বা সমাবেশে মাইকের ব্যবহার অবিচ্ছেদ্য অংশ দাঁড়িয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত মাইকের আওয়াজ শব্দদূষণের অন্যতম একটি কারণ।
এছাড়াও নির্বাচনী মিছিল বা শোডাউন করতে শত মানুষের ধ্বনির সঙ্গে বর্তমান সময়ে যোগ হয়েছে শত মোটরবাইকের ইঞ্জিনের বিকট শব্দ। এরই সঙ্গে অতি উৎসাহী সমর্থকের বাইকের হর্নের আওয়াজ শব্দদূষণের মাত্রা আরও একধাপ বাড়িয়ে দেয়।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা গত নভেম্বর মাসে মিছিলের সময় ধানমণ্ডির বিভিন্ন পয়েন্টে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে।
এতে দেখা যায়, মিছিলে সর্বনিু শব্দের মাত্রা ছিল ১০০ ডেসিবল এবং সর্বোচ্চ ১১০ ডেসিবল।
‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা ২০০৮’-এর ‘বিধি-৮ (যানবাহন ব্যবহার সংক্রান্ত বাধা-নিষেধ) এ বলা হয়েছে ‘কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা উহার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাহাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি- (ক) কোনো ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেল, নৌযান, ট্রেন কিংবা অন্য কোনো যান্ত্রিক যানবাহন সহকারে মিছিল কিংবা মশাল মিছিল বাহির করিতে পারিবে না কিংবা কোনোরূপ শোডাউন করিতে পারিবে না; (খ) মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কোনো ধরনের মিছিল বা শোডাউন করিতে পারিবে না।’
কিন্তু বাস্তবে বিধি মোতাবেক কোনো মিছিল বা শোডাউন কিছুই হচ্ছে না। উল্লেখ্য যে, নির্বাচন আচরণবিধির কোনো অংশেই প্রচারণা কাজে সৃষ্ট শব্দের মানমাত্রার কথা উল্লেখ নেই।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে নির্ধারিত শব্দের মানমাত্রা নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকার জন্য দিবাকালীন যথাক্রমে ৫০, ৫৫, ৬০, ৭০ ও ৭৫ ডেসিবল এবং রাত্রিকালীন যথাক্রমে ৪০, ৪৫, ৫০, ৬০ ও ৭০ ডেসিবল।
এই আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য ১ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
নির্বাচনী প্রচার কাজে সাউন্ড সিস্টেমের জন্য ব্যবহার করা হয় লেড এসিড ব্যাটারি। এ ধরনের ব্যাটারি থেকে লেড বা সিসা বায়ুতে মিশে বায়ুদূষণ করে। এছাড়াও মিছিল চলাকালীন মানুষ ও গাড়িবহরের কারণে ধুলাদূষণ হয়।
মিছিলে আগত শত শত সমর্থকদের প্রার্থীর পক্ষ থেকে খাদ্য ও পানীয় বোতল প্রদান করা হয়। খাদ্যের উচ্ছিষ্ট, ঠোঙ্গা ও খালি বোতল কোনো ধরনের? ব্যবস্থাপনা ছাড়াই রাস্তায় ফেলে রাখা হয়; ফলে পরিবেশ নোংরা হয়।
মিছিল, মিটিং ও অন্যান্য জনসভার দরুন রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজটে স্থবির হয়ে থাকা গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকার ফলে স্থানীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে নির্বাচন বিধি ছাড়াও প্রধান ৪টি পরিবেশ আইন ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এগুলো হল- ১. শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬, ২. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, ৩. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (সংশোধিত) ২০১০ এবং ৪. কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমাল (খসড়া) ২০১৮।
সব মিলিয়ে নির্বাচনী প্রচার কাজে ব্যয় হবে বিপুল অঙ্কের টাকা। The Representation of the People Oder, 1972-এর Article-44B Ges Clause-3 অনুযায়ী ৮ নভেম্বর ২০১৮ নির্বাচন কমিশনের দেয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে- ‘একটি নির্বাচনী এলাকার ব্যয় সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার বেশি হইবে না।’
এরূপ ৩০০ আসনে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা যে পরিমাণ টাকা ভোটের প্রচারণায় ও অন্যান্য কাজে ব্যয় করেন, তা দিয়ে দেশের পরিবেশ বিষয়ক অনেক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব।
ইতিমধ্যে বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের The Global Liveability Index-2018 প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা শহরের অবস্থান দ্বিতীয়।
তাই এখনই সময়, নির্বাচিত হলে কী করা হবে, তা বলার আগে নির্বাচনী প্রচারকালে পরিবেশকে কতটুকু সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে; তা বিবেচনায় নেয়া। প্রচারণা কাজে কাগজ ও প্লাস্টিক, মাইক ইত্যাদি ব্যবহার কমিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে প্রচার করা যেমন- সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা।
নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আচরণবিধি রক্ষা ও সার্বিক পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার জন্য যথেষ্ট আন্তরিক।
তা সত্ত্বেও ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ জন ভোটারের এবং অন্তত ১ হাজার ৮৪১ জন প্রার্থীর মধ্যে কোথায় নির্বাচন আচরণবিধি কতটুকু মানা হচ্ছে বা লঙ্ঘন হচ্ছে এবং কোথাও পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করা দুরূহ ব্যাপার।
নিজের চারপাশের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্ব মনোনীত প্রার্থীর ও দেশের সাধারণ জনগণের।
নির্বাচনে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের উচিত- আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পটকাবাজি না করে, আনন্দ মিছিল বের করে ভুভুজেলা ও মোটরবাইকের হর্ন না বাজিয়ে শব্দ ও বায়ুদূষণ না করা। অপরদিকে পরাজিত দলের প্রতিবাদের ভাষা যেন টায়ার পোড়ানো না হয়।
সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পরিবেশবাদীদের দাবি- এ নির্বাচনে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে মানবিক পরিবেশও যেন নিশ্চিত করা হয়।