by Team CAPS, 0 Comments
প্রকৃতিতে বিস্ময়কর পরিবর্তন প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে যার ফলে হুমকির সম্মুখীন প্রাণীকুল, ইতোমধ্যেই বিলুপ্তি হয়ে গেছে অনেক প্রজাতি। আমরা আমাদের চারপাশে যদি একটু লক্ষ করি তাহলেই খুঁজে পাব এ পরিবর্তন। যেমন- তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রীষ্মকাল বৃদ্ধি পেয়েছে অপরদিকে শীতকাল হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে শুধু যে বর্ষাকালে বৃষ্টি হচ্ছে এমন না অন্যান্য মৌসুমেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে ব্যাপক, এর ফলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দিচ্ছে। এ সবই প্রকৃতির বিস্ময়কর পরিবর্তন এর ফলে ঘটেছে। এ পরিবর্তন এর জন্য গবেষকরা মানুষের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করেছেন, বিশেষজ্ঞরা গবেষণার মাধ্যমে যে ফলাফলগুলো পেয়েছেন তার বেশিরভাগই মানুষের কর্মকাণ্ড দায়ী করে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যান্য দুর্যোগের মধ্যে একটি অন্যতম দুর্যোগ হলো পাহাড় ধস। বিশ বছর আগেও পাহাড় ধস আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে আবহাওয়া ও জলবায়ু তথা পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে এটি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু যে প্রাকৃতিক কারণে পাহাড় ধস হচ্ছে তা নয় এর পেছনে রয়েছে মানব সৃষ্ট অনেক কারণ।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে মূলত বেশিরভাগ পাহাড়ের অবস্থান। ২০০৭ সালের ১১ জুন ঘটে যাওয়া পাহাড় ধসে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। এই দুর্যোগে পৃথক ৭টি স্থানে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২০১১ সালের ১ জুলাই বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে নিহত হন ১৭ জন। ২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর ৪ স্থানে পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৮ জন। ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি খুলশী থানার ইস্পাহানি গোল পাহাড় সি গেট এলাকায় ১ জন মারা যান এবং ২৯ জুলাই লালখান বাজারের টাংকির পাহাড় এলাকায় ২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৭ সালে ১২০ জনের মৃত্যু ঘটে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ। রাঙ্গামাটি সদরের লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন মুসলিম পাড়ার সড়ক থেকে অন্তত ৫০ ফুট নিচে তিনটি পাহাড়ের মাঝখানে পাহাড় কেটে বসতি গড়ে উঠেছিল, পাহাড় ধসের ফলে ওই এলাকার প্রায় সব বাড়ি গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাঙ্গামাটি সড়ক জনপথ বিভাগের তথ্যানুযায়ী এই বছরের ১২ জুন (২০১৮) রাঙ্গামাটি জেলায় প্রায় ১২৮টি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে এবং পাঁচটিরও অধিক স্থানে সড়ক ভেঙে গেছে। এতে নিহতের সংখ্যা ১১ জন। এভাবে প্রতি বছরই চলছে পাহাড় ধস আর দীর্ঘ হচ্ছে নিহতের তালিকা।
বাংলাদেশের পাহাড় ধসে প্রাণহানি হওয়ার জন্য তিনটি সমস্যা চিহ্নিত করা যায়। সেগুলো হলো আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য ও রাজনৈতিক সুদৃষ্টির অভাব। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা প্রাচীন থেকেই জুম চাষাবাদে নির্ভরশীল। এই পদ্ধতিতে চাষাবাদে বহু গাছপালা কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে জুম চাষে সঠিক পদ্ধতিতে লাঙ্গল-কোদাল ব্যবহার না করার ফলে পাহাড়ের মাটির উপরের অংশটুকু ঝুর ঝুর হয়ে যায় এবং একটানা বৃষ্টিপাতে তা ধসে পড়ে আর বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়গুলোর বৈশিষ্ট্য হলো সেগুলো বালুময় এবং ভেতরে অনেক ফাটল রয়েছে। পরিবেশগতভাবেই অতিবৃষ্টিতে প্রাকৃতিকভাবে সেই ফাটলে পানি ঢুকে যায় এবং মাটি নরম হয়ে যায়। যার ফলাফল পাহাড় ধসের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। রাজনৈতিকভাবে সমস্যা হলো অবৈধভাবে প্রতিনিয়ত দুর্বৃত্তরা বহু পাহাড় কেটে ফেলছে, প্রচুর গাছপালা নিধন করছে। সে সব পাহাড়ের নিচেই বসতি স্থাপন হচ্ছে। পাহাড় ধসে সে বসতি গুঁড়িয়ে নিয়ে যায় কিন্তু এ সবকিছু কেউ পুরোপুরি থামাতে পারছে না। পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের মাটির দৃঢ়তা হ্রাস পায়, পাহাড়ের বিস্তৃতি কমে যায়। যার কারণে ভারি বৃষ্টিপাতে অথবা ভ‚মিকম্পে পাহাড় ধসে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এ সব সমস্যা প্রশাসন কর্তৃক পুরোপুরি থামানো যাচ্ছে না।
২০০৭ সালের পাহাড় ধসে ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গঠিত হয় ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’। ৮ বছরে এই কমিটির ১৫টি সভা হয়েছে। কমিটির সভাগুলোতে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদ, পুনর্বাসন ও অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়েও ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী কিছু পরিবার উচ্ছেদ করা হয় এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর ফিরিয়ে আনছে। কিন্তু এটা কোনো টেকসই সমাধান নয়।
এ ক্ষেত্রে আমাদের বন্ধ করতে হবে পাহাড় কেটে সম্পদ আহরণ, বন্ধ করতে হবে পাহাড়ে জায়গা দখল করা, পাহাড়ি গাছপালা নিধন করা থেকে বিরত থাকতে হবে আর পাহাড়ের খালি জায়গায় পাহাড়ি পরিবেশের জন্য উপযুক্ত গাছ লাগাতে হবে। কিছু কিছু উদ্ভিদ আছে যা মাটি ধসে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে এবং পাহাড়ি পরিবেশেও উপযুক্ত। যেমন- শন, ঝাড়ু ফুল গাছ, বাঁশগাছ আরো বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও লতা। এ ধরনের গাছগুলোর শেকড় খুব ঘন, শক্ত ও ছোট-বড় হয়। এ ধরনের ছোট-বড় শেকড় একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে যে দেখতে জাল মনে হয় যা মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে। এমন কিছু উদ্ভিদও আছে যাদের শিকড় মাটির ভিতর অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে এবং মাটিকে মজবুত করে। শুধু বৃক্ষরোপণ বা সংরক্ষণ করলে হবে তা না, পাহাড় ধস রোধে পাহাড় কাটা থেকেও বিরত থাকতে হবে।
