জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হলো মিথেন গ্যাস। প্রাকৃতিকভাবে আমাদের বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন রকমের গ্যাস ও জলীয় বাষ্প থাকে; আর মিথেন তারই একটি। প্রকৃতিতে নানা রকম পচনের ফলে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। যদিও এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে খুব অল্প সময়ের জন্য থাকে, কিন্তু বায়ুমণ্ডলে এর পরিমাণ বৃদ্ধির ভয়াবহতা ব্যাপক।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে ব্লুমবার্গ মিডিয়ায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক মাত্রায় মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে, যা ছড়িয়ে পড়ছে বায়ুমণ্ডলে। বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনকে সরিয়ে দিয়ে এর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে এই মিথেন গ্যাস। ফলে নানা রকম শারীরিক সমস্যায় পড়ছে মানুষ। যেমন শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ ও অবসাদ। তা ছাড়া বায়ুমণ্ডলে পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি তো আছেই। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের আকাশে যে মিথেন গ্যাসের স্তর দেখা যাচ্ছে, তাকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর ১২তম মিথেনের উৎস। তবে বাংলাদেশে আসলেও এই পরিমাণ মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে কিনা; হয়ে থাকলে তার সমাধান কী, তা বের করা খুব জরুরি।
ব্লুমবার্গ মোট ২টি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার প্রথম প্রতিবেদনটি সে বছর ১৭ এপ্রিল এবং দ্বিতীয়টি ২৫ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়। প্রথম প্রতিবেদনটি মিথেনের নিশ্চিত উৎস শনাক্ত করতে পারেনি। কিন্তু দ্বিতীয় প্রতিবেদনে তারা বলেছে, আমাদের মাতুয়াইলের ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে, যা প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার গ্যাস লাইন লিকেজ গাড়ির দূষণের সমান। উৎস হিসেবে প্রতিবেদনে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তার সর্বপ্রথম উৎসে বলা হয়েছে আমাদের দেশে ধান উৎপাদনকে। ধানক্ষেত থেকে মিথেন উৎপন্ন হয়। দ্বিতীয়ত কয়লার খনি এবং তৃতীয়ত গ্যাসের খনি থেকে। আর চতুর্থত ময়লা-আবর্জনার স্তূপ থেকে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন, ভারত প্রায় ১৪ কোটি টন, চীন প্রায় ২০ কোটি টন ধান উৎপাদন করে থাকে। ঢাকা যেমন আমাদের দেশে বড় শহর; এর চেয়ে আরও বড় শহর আছে ভারতে; চীনে আছে আরও বেশি সংখ্যক। আমাদের কয়লার খনি আছে ১টি বড়পুকুরিয়ায়; ভারতে আছে প্রায় ১০০টি এবং চীনে দুই সহস্রাধিক। যদি ব্লুমবার্গের মতে, ঢাকার আকাশে মিথেনের উপস্থিতি বেশি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীনের মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ ব্লুমবার্গের স্যাটেলাইটে ধরা পড়ছে কিনা– প্রশ্নবিদ্ধ করে।
অপরদিকে ব্লুমবার্গের দ্বিতীয় প্রতিবেদনে মাতুয়াইলের ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ঘণ্টায় চার হাজার কেজি মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে বলে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এটি রহস্যময়। কারণ কলকাতায় বৃহত্তম ডাম্পিং গ্রাউন্ড ধাপায় প্রতিদিন প্রায় চার হাজার টন বর্জ্য ফেলা হয়; আর মাতুয়াইলে ফেলা হয় মাত্র আড়াই হাজার টন। বর্জ্য থেকে যদিও মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়ে থাকে, তাহলে সেটি একই প্রকৃতির দুটি ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকেই সমান হারে নির্গত হওয়ার কথা। কিন্তু রিপোর্টে ধাপা ডাম্পিং গ্রাউন্ডের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। এ ক্ষেত্রে সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যদি ঢাকাতে মিথেন গ্যাস উৎপাদন হয়, তাহলে পাশের দেশে কেন তা উৎপাদন হচ্ছে না?
মিথেন গ্যাস শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এটি কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে হালকা এবং ভূমি থেকে ৩০ কিমি পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, আমাদের দেশের মিথেন গ্যাস আসলেই কি আমাদের দেশে উৎপন্ন হচ্ছে, নাকি অন্য দেশ থেকে উড়ে আমাদের সীমানার আকাশে দেখা যাচ্ছে? আইসোটোপ পরীক্ষার মাধ্যমে এর সঠিক উৎস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
মিথেন গ্যাস মোকাবিলায় অন্যান্য দেশ বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করছে। বিশ্বের মোট মিথেনের মাত্র ৩ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। অর্থাৎ পৃথিবীর সব দেশ মিলে যাবতীয় কৃষি উৎপাদন ও গবাদি পশু মিলে মাত্র ৩ শতাংশ মিথেন উৎপন্ন হয়, সেখানে বাংলাদেশে অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আর বর্জ্য পানির কথা তুলে ধরলে সারা পৃথিবীর সব দেশ মিলে ৭ শতাংশ মিথেন বর্জ্য পানি থেকে আসে। সেখানে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী অতি ক্ষুদ্র দূষিত নদী। তেল ও গ্যাস থেকে ২৪ শতাংশ, ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ১১ শতাংশ, কয়লার খনি থেকে ৯ শতাংশ। উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশে মিথেন উৎপাদনের ভূমিকা অতীব সামান্য।
সমস্যা হলো, মিথেন নির্গমন সংক্রান্ত আমাদের কাছে কোনো ডাটাবেজ নেই। আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থার এ ধরনের প্রতিবেদন গ্রহণ বা অস্বীকার করতে পারি না। সে জন্য বাস্তব পরিস্থিতি মূল্যায়নে সাইট এবং স্যাটেলাইট উভয় ডাটার সংমিশ্রণসহ একটি সম্পূর্ণ ডাটাবেজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইতোমধ্যে আমিনবাজারে বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ রকম প্রকল্পও ঢাকাসহ সারাদেশে মাঝারি ও বড় শহরগুলোতে তৈরি করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দেশভিত্তিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। ১১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৯৫তম। এর পর আমরা যতটুকু মিথেন উৎপন্ন করি বলে ধারণা ছিল, তার চেয়ে অধিক উৎপন্ন করে থাকলে তা নিজস্ব গবেষণা করে দেখা উচিত।
অবশ্য ব্লুমবার্গ প্রতিবেদনের পরবর্তী সময়ে সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন রোধে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। মিথেন নিয়েও অনতিবিলম্বে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বাংলাদেশের অবস্থান সুস্পষ্ট করা উচিত।
