by Team CAPS, 0 Comments
২০১৮ সালে আমাদের এই প্রাণের শহর ঢাকাকে বসবাস অযোগ্য ঘোষণা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। আর এই বসবাস অযোগ্য হওয়ার একটি অন্যতম কারণ ঢাকার পরিবেশ। ঢাকার পরিবেশ দিনে দিনে আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদানটি হলো বায়ু। ওই উপাদান ছাড়া আমরা বেঁচে থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না। এ উপাদানটি আমাদের অসচেতনার কারণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। সবাই জেনেও এমনসব কর্মকা-ে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছি- যার কারণে বায়ুদূষণের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি দূষণের ফলে আমাদের ভোগান্তির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন যৌথ উদ্যোগে স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। প্রতিবেদন আনুযায়ী বিশ্বের ১০টি দেশের মধ্যে বায়ুদূষণে মৃত্যুর সংখ্যায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে বায়ুদূষণের কারণে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। রিপোর্টে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহারের জন্য পঞ্চম ঝুঁকির কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকে দায়ী করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন আনুযায়ী বায়ুদূষণ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ। প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং আরও বলা হয়, উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলো চার থেকে পাঁচগুণ বেশি চগ২.৫ দূষণের শিকার হয়। বায়ুদূষণ বিশ্বব্যাপী গড় আয়ু ১ বছর ৮ মাস কমিয়ে ফেলে। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় আয়ু আরও কমে গিয়ে ১ বছর ৭ মাসে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের অনেক অংশে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরুধঃরড়হ (ডঐঙ)-এর তথ্য অনুযায়ী ৯০ শতাংশ মানুষ দূষিত বায়ুগ্রহণ করছে। ফলস্বরূপ- প্রতিবছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ বহিরাগত বায়ুদূষণ ও গৃহস্থালির বায়ুদূষণের পার্টিকুলেট ম্যাটারের এক্সপোজারের কারণে মারা যায়। এগুলোর মধ্যে বহিরাগত বায়ুদূষণের কারণে ৪.২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। বায়ুদূষণের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।
নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিলুর (ঘওখট) সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৬ সালে বায়ুদূষণের উৎস চিহ্নিত বিষয়ে একটি গবেষণা করে। গবেষণা অনুযায়ী বায়ুদূষণের জন্য দায়ী উৎসগুলোর পরিমাণ যথাক্রমে ইটের ভাটা ৫৮, যানবাহনের ১০, বিভিন্ন জ্বালানি বা কাঠ পোড়ানোর ৮ ও অন্যান্য ৬ শতাংশ। এসব উৎস থেকে নির্গত হচ্ছে ধূলিকণা, পার্টিকুলেট ম্যাটার (চগ), কার্বন মনোক্সাইড (ঈঙ), সালফার অক্সাইডগুলো (ঘঙঢ) ও নাইট্রোজেন অক্সাইডগুলো (ঝঙঢ)। তা বায়ুদূষিত করছে। ঢাকার বিভিন্ন যায়গায় অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ ও রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের নামে রাস্তাঘাট খোঁড়ার কারণে বায়ুতে ধূলিকণা মিশ্রিত হয়ে যায়। ড্রেন পরিষ্কারের পর বর্জ্যগুলো রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়। তা ধুলাদূষণের জন্য দায়ী। উপরন্তু ড্রেনের বর্জ্যে প্যাথজেনের উপস্থিতি থাকায় নির্মল বায়ু হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর। এ ছাড়া বায়ুতে সিসা, ফরমালডিহাইড, তামা, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদির উপস্থিতি বায়ু দূষিত করে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ ও ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ঢাকার ১২টি স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে চগ২.৫-এর পরিমাণ পর্যালোচনা করে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে- যেসব এলাকায় গাড়ি নেই, সেসব এলাকায় চগ২.৫-এর মান সবচেয়ে কম (৪০ চগ২.৫)। কিছু এলাকায় অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচল করে। ওই এলাকাগুলোয় চগ২.৫-এর পরিমাণ তুলনামূলক কম (৪৬.০ চগ২.৫)। অন্যদিকে যেসব এলাকায় যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক- উভয় গাড়ি রয়েছে, ওই এলাকায় চগ২.৫-এর পরিমাণ তুলনামূলক একটু বেশি (৮৪.৭ চগ২.৫)। যেসব এলাকায় যান্ত্রিক গাড়ি চলাচল করে, সেখানে চগ২.৫-এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি (১৭২.২ চগ২.৫)। গবেষণা থেকে বলা যায়- যেসব এলাকায় যান্ত্রিক গাড়ির পরিমাণ বেশি, সেসব এলাকায় বায়ুদূষণের পরিমাণও বেশি।
আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আইনিভাবে বায়ুদূষণ প্রতিকার এবং প্রতিরোধ করতে হবে। নিজেদের বায়ুদূষণের ব্যাপারে সচেতন হতে ও অন্যদের সচেতন করতে হবে। যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভার্টর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজি গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে পাবলিক পরিবহন ব্যবহারের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করতে হবে। সবাইকে সাইকেল ব্যবহারের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শিশুস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি এই বায়ুদূষণ এবং এ থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সুসমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় শিক্ষামূলক প্রচার চালাতে হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনিকব্যবস্থার সফল প্রয়োগ একান্তভাবে প্রয়োজন। জনগণকে বায়ুদূষণের সামগ্রিক বিষয়ে তথ্য প্রদান, শিক্ষিতকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণ অত্যন্ত জরুরি। সবকিছুর পাশাপাশি সবাইকে সাইকেলিংয়ের ব্যাপারে উৎসাহী করতে হবে।
