by Team CAPS, 0 Comments
শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২১’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘বায়ুদূষণের কারণে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস এবং শুধু ঢাকায় মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। ’ বায়ুদূষণের ফলে গড় আয়ু কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যাও হয়ে থাকে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ গত ছয় বছরের বায়ুমান সূচক বা AQI-এর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৯.৮ শতাংশ।
এতে আরো দেখা যায় যে গত ছয় বছরের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ২ শতাংশ (৩৮ দিন) সময় ভালো বায়ু সেবন করে। তবে এ ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ (৫১০ দিন) মধ্যমমানের বায়ু, ২৯ শতাংশ (৫৭৭ দিন) সংবেদনশীল বায়ু, ২২ শতাংশ (৪৪৩ দিন) অস্বাস্থ্যকর, ১৯ শতাংশ (৩৮৫ দিন) খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ২ শতাংশ (৩৭ দিন) দুর্যোগপূর্ণ বায়ু গ্রহণ করে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ২০২২-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৪২ দিন বায়ুমান অস্বাস্থ্যকর থেকে খুব অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় অবস্থান করে, এর মধ্যে এক দিন (২২ জানুয়ারি) বায়ুমান সূচক ছিল ৩১৩, যা দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা। এখনই যদি বায়ুদূষণ রোধে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া না হয়, বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে? বায়ুদূষণ রোধে আমাদের কিছু স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ ও কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ছয় বছরের (২০১৬ থেকে ২০২১ সাল) গড় বায়ুমান সূচক বা AQI অনুযায়ী ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি দূষণ লক্ষ করা যায় এবং ২০১৬ সালে সবচেয়ে কম দূষণ লক্ষ করা যায়। দিন থেকে রাতে বায়ুদূষণের পরিমাণ বেশি থাকে।
ইউএসএইড এবং এফসিডিওর অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রকল্পের আওতায় ক্যাপস ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের বায়ুমানের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে। ওই গবেষণায় ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যথাক্রমে আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, শাহবাগ, ধানমণ্ডি-৩২, সংসদ এলাকা, তেজগাঁও, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২-এর বায়ুমান নিউজিল্যান্ডে তৈরি ইউএসইপিএ সার্টিফায়েড অ্যারোকুয়াল এস-৫০০ মেশিন দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এই গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে ১০টি স্থানের বস্তুকণা ২.৫ ও বস্তুকণা ১০-এর উপাত্তগুলো প্রাক-বর্ষা, বর্ষাকাল, বর্ষা-পরবর্তী, শীতকাল চারটি মৌসুমের মধ্যে শীতকালে দূষণের পরিমাণ অন্য মৌসুমের তুলনায় বেশি ছিল। শীতকালে গড়ে বস্তুকণা ২.৫ উপস্থিতি ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০১ মাইক্রোগ্রাম এবং বস্তুকণা ১০-এর উপস্থিতি ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১২১ মাইক্রোগ্রাম। বর্ষা মৌসুমে গড়ে বস্তুকণা ২.৫ উপস্থিতি ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩৯ মাইক্রোগ্রাম এবং বস্তুকণা ১০-এর উপস্থিতি ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৬২ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ বর্ষাকালের তুলনায় শীতকালে বস্তুকণা ২.৫-এর পরিমাণ জাতীয় মান মাত্রার (প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম) প্রায় ২.৫ গুণ বেশি এবং বস্তুকণা ১০-এর পরিমাণ জাতীয় মান মাত্রার (প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম) প্রায় দুই গুণ বেশি ছিল। অন্যদিকে মাস অনুযায়ী ১০টি স্থানের গড় বস্তুকণা ২.৫ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসে বস্তুকণা ২.৫ প্রতি ঘনমিটারে ১০২ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায় এবং জুলাই মাসে ২৯.০১ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়।
বায়ুদূষণ রোধে করণীয়
শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ তীব্র আকার ধারণ করে। ঢাকা শহরের শীতকালে বায়ুদূষণ রোধ করার জন্য স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতিগুলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর। এ ক্ষেত্রে দূষণ থেকে ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য উন্নতমানের মাস্ক ব্যবহার করা ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটি অস্থায়ী সমাধান হতে পারে। তবে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ কমাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সংস্থাগুলোর সমন্বয় বাধ্যতামূলক করতে হবে। সমন্বয়হীনতা ও বাজেট জটিলতার ফলে বেশির ভাগ সময়ই একবার রাস্তা খননের পর তা কার্পেটিংয়ের জন্য দীর্ঘদিন উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। এ সময় গাড়ি চলাচলের ফলে ওই রাস্তার ধুলাবালি থেকে বায়ুদূষণ হয়। যদি সব সংস্থা তাদের সংস্কারকাজের জন্য রাস্তা খননের জন্য একীকরণ প্রক্রিয়া বজায় রাখে, তবে সংস্কার বা উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে বায়ুদূষণ হ্রাস করতে পারে। রাজধানী শহরে বালু, মাটি বা নির্মাণসামগ্রী পরিবহনকারী ট্রাকগুলো যেন ঢেকে নেওয়া হয়, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
শুষ্ক মৌসুমে, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে দিনে দুইবার সড়কে পানি দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস এবং বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের বেশ কিছুসংখ্যক পানি ছিটানোর যানবাহন রয়েছে। ঢাকা শহরের ধুলাবালি সাময়িকভাবে কমাতে এগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে রাস্তায় পানি ছিটানো বা স্প্রে করা অত্যন্ত কার্যকর। প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তায় প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা অন্তর অন্তর নিজ উদ্যোগে পানি ছিটাতে বিল্ডিং কর্তৃপক্ষকে সিটি করপোরেশন অনুরোধ করতে পারে। এ কাজে বিল্ডিং কর্তৃপক্ষ এসি থেকে প্রাপ্ত পানি ব্যবহার করতে পারে।
ফিটনেসবিহীন যানবাহন ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। অতএব মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং কালো ধোঁয়া নির্গত যানবাহন আটক করা বায়ুদূষণ রোধে একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে গাড়ির জোড় ও বেজোড় নম্বর প্লেট অনুযায়ী অসম ড্রাইভিং বা বিকল্প দিনের চলাচলের প্রবর্তন করা যেতে পারে।
ঢাকায় বায়ুদূষণ কমাতে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ রয়েছে। এ ছাড়া মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। ডাম্পিং স্টেশনের পাশাপাশি রাস্তার পাশে বর্জ্য পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ উভয় সিটি করপোরেশনকে উন্মুক্ত বর্জ্য ফেলার পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ সমস্যা হ্রাস করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মধ্যমেয়াদি কিছু কৌশল নিতে পারে, যা আগামী ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা যেতে পারে। এর মধ্যে রাস্তা পরিষ্কার এবং রাস্তার ধুলো সংগ্রহের জন্য ম্যানুয়াল ঝাড়ুর পরিবর্তে সাকশন ট্রাক এবং ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাকের প্রচলন করতে পারে। এটি রাস্তার ধুলো থেকে বায়ুদূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ কমানোর জন্য পৃথক সাইকেল লেন অন্যতম প্রধান পদক্ষেপ হবে। পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ এবং ছাদবাগান বায়ুমান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ কমাতে ঘরের অভ্যন্তরে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন তৈরি, নিয়মনীতি প্রণয়ন, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বাজেট বৃদ্ধিসহ পরিবেশ পুলিশ নিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সবার আগে সবাইকে একযোগে সমন্বিত, টেকসই, বিজ্ঞানভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে। এর জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে একটি প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করে পৃথক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় নির্মল বায়ু আইন-২০১৯-এর পরিবর্তে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ নীতি নিয়ে কাজ করছে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ইট প্রস্তুত ও ইটখোলা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া কোনো ইটখোলার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না।
গত ১৫ ফেরুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট ঢাকা, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার ৩১৯টি অবৈধ ইটখোলার তথ্য জানিয়ে বলেছেন, এই পাঁচ জেলাসহ সারা দেশের চলমান সব অবৈধ ইটখোলা বন্ধ করতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আবার গত ১৫ ফেরুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি দেশের সবচেয়ে দূষিত এলাকাগুলোর তালিকা করা এবং দূষণ কমাতে কী পরিকল্পনা করা যায় তা জমা দেওয়ার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে উপযুক্ত স্থানে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ‘কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন’ বসানো এবং বিপজ্জনক-অস্বাস্থ্যকর বায়ু থেকে জনগণকে রক্ষায় ‘অ্যালার্ট (সতর্কবার্তা) পদ্ধতি’ চালু করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া পোড়ানো ইটের বিকল্প পদ্ধতির উন্নয়ন ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে আরো বেশি তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। প্রতিটি উপজেলায় একজন পরিবেশ কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে এবং এটি নিশ্চিত করার জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিসিএসে পরিবেশ ক্যাডার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাহায্য বা সুপারিশ নেওয়া যেতে পারে।
শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারা একা বায়ুদূষণের উৎসগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন জনমানুষের সচেতনতার। সঠিক দিকনির্দেশনা, জ্ঞান এবং অনুপ্রেরণার মাধ্যমে জনসাধারণকে ঢাকা শহরের বায়ু ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ করা যেতে পারে।
