বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে এক কথায় দেশব্যাপী অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে, যা তাপপ্রবাহ নামে পরিচিত। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ক্রমবর্ধমান ধারার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো গাছ কাটা। নগর এলাকায় এমনিতেই সবুজের পরিমাণ কম থাকে। দেশের উল্লেখযোগ্য বনভূমি যেমন সুন্দরবন, পাহাড়ি বন, সিলেট অঞ্চলের চা বাগান বিশিষ্ট বনভূমি, সমতল বনভূমি, সামাজিক বনায়ন এবং সংরক্ষিত বনভূমির পাশাপাশি সড়কের দুপাশ ও সড়কদ্বীপের গাছগুলোও মোট বৃক্ষসম্পদের আওতাভুক্ত। দেশের সাধারণ বনভূমি যেমন প্রকৃতিতে অশেষ অবদান রাখছে তেমনি সড়কের পাশের গাছ বা শহরাঞ্চলের স্বল্প পরিমাণ গাছের অবদানও প্রকৃতিতে কম নয়। দিন দিন শহরাঞ্চলের গাছপালার পরিমাণ কমে গিয়ে সংকটাপন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশবিদদের মতে, গত দুই যুগে শহরের গাছপালা প্রায় ৪০ ভাগ কমে গেছে। সম্প্রতি বৃক্ষনিধনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্নরকম বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশের স্বার্থে এসব উন্নয়ন অপরিহার্য, কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে গাছ রক্ষার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় না নিয়ে অবহেলা করা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে গাছকে বাঁচিয়ে রেখে উন্নয়ন করার যে তাগিদ থাকে তা আমাদের দেশের কাজগুলোতে অনুপস্থিত। শুধু মেগা প্রকল্পগুলোতেই যে গাছ কাটা হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়, ছোট ছোট সৌন্দর্যবর্ধক প্রকল্পেও গাছ কাটা হচ্ছে। যেখানে গাছকে পরিকল্পিতভাবে স্ব-অবস্থানে রেখে সৌন্দর্যবর্ধন করা যায় সেই পরিকল্পনায় না গিয়ে গাছ নিধনের মহাযজ্ঞ চলছে। প্রাপ্তবয়স্ক একটি গাছের যে কত উপকারী দিক আছে তা বিবেচনা না করে আমরা পূর্ণাঙ্গ গাছ কেটে সেখানে চারাগাছ লাগিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন করতে চাচ্ছি। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী কর্র্তৃপক্ষের অনুধাবনের ঘাটতি রয়েছে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছ যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং যে পরিমাণ অক্সিজেন, ছায়া ও জলীয় বাষ্প দেয় তা কখনই একটি চারাগাছ দিতে পারবে না। একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছে ইকোসিস্টেম সার্ভিস ভ্যালু রয়েছে, নান্দনিক সৌন্দর্য রয়েছে। কিন্তু একটি চারাগাছের এতসব উপকার দিতে অন্তত ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগে। ২টি বা ৩টি চারাগাছ কখনই একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছের বিকল্প হতে পারে না।সাতমসজিদ সড়ক গাছ রক্ষা আন্দোলন কর্মীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সড়কটির পিলখানা থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর পর্যন্ত সড়ক বিভাজকের প্রায় ৬০০ গাছ কাটা হয়েছে। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)-এর ২০২০ সালের জরিপে দেখা যায় যে, ১৯৯৯ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় সবুজ ও খোলা জায়গার পরিমাণ ছিল ২১ শতাংশ, পরে ২০২০ সালে ঢাকার সবুজ এলাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ, বর্তমানে তা সাড়ে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ঢাকা শহর যত উন্নত হচ্ছে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ দিন দিন ততই কমে যাচ্ছে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল ২০১৭ সালে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ গবেষণায় জরিপকাজের জন্য গ্রীষ্মকাল এবং শীতকালের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়। ঢাকা শহরের মোট ৩৬টি স্থানে গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের জন্য স্বয়ংক্রিয় তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ২১টি স্থান এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১৫টি স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল।
ক্যাপস-এর গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকা শহরে নির্বাচিত স্থানগুলোর মধ্যে গ্রীষ্মকালে ৪টি স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। স্থানগুলো হলো যথাক্রমে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় (৩৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস), মতিঝিল শাপলা চত্বর (৩৫.৫ ডিগ্রি সে.), মিরপুর ১০ নম্বর এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল (৩৫.০ ডিগ্রি সে.)। গ্রীষ্মকালে ৩টি স্থানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৪.০ ডিগ্রি সে. রেকর্ড করা হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, রমনা পার্ক, চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে।
একইভাবে শীতকালে ঢাকার তাপমাত্রা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ৪টি স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। স্থানগুলো যথাক্রমে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় (২৬.০ ডিগ্রি সে.), মতিঝিল শাপলা চত্বর, মিরপুর ১০ নম্বর এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল (২৫.৫ ডিগ্রি সে.) এবং ৬টি স্থানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১.০ ডিগ্রি সে. রেকর্ড করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, বুয়েট, পিলখানা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, রমনা পার্ক, চিড়িয়াখানা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনের জলাশয়ের নিকটবর্তী এলাকায়। এ ছাড়াও ধানম-ি লেকের চারপাশের তাপমাত্রাও তুলনামূলকভাবে কম পরিলক্ষিত হয়।
ক্যাপস-এর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণের মাধ্যমে আরও দেখা যায় যে, ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ২৫.৮৮ ডিগ্রি সে. রেকর্ড করা হয় তেজগাঁও শিল্প এলাকাতে এবং সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ২২.১৩ ডিগ্রি সে. রেকর্ড করা হয় রমনা পার্ক, চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন অঞ্চলে। অর্থাৎ শুধু জলাভূমি ও বৃক্ষ কম থাকার কারণে তেজগাঁও শিল্প এলাকা এবং চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকার মধ্যকার গড় তাপমাত্রার পার্থক্য ৩.৭৫ ডিগ্রি সে.।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, বুয়েট, পিলখানা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, রমনা পার্ক, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন ইত্যাদি স্থানে গাছপালা ও জলাশয়ের পরিমাণ বেশি থাকায় এসব স্থানের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। অন্যদিকে তেজগাঁও শিল্প এলাকা, মতিঝিল শাপলা চত্বর এবং মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় গাছপালা ও জলাশয় কম থাকার কারণে তাপমাত্রা সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়েছে। শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়াতে এসব স্থানে বড় বড় বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠেছে। ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণগুলো তাপ অন্তরক বা ধরে রাখার ক্ষমতাসম্পন্ন হয়, যা দিনের বেলায় তাপ শোষণ করে বা ধরে রাখে এবং সন্ধ্যার দিকে যখন সূর্য অস্ত যায় তখন এই তাপ পরিবেশে ছেড়ে দেয়। পক্ষান্তরে, ঢাকার যেসব স্থানে গাছপালা রয়েছে সেখানে দ্রুত শীতল হতে থাকে। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভবনগুলো এত কাছাকাছি নির্মাণ করা হয় যার কারণে ভবনের মাঝখান দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে না। এটিও তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ক্যাপসের গবেষণা থেকে আরও পরিলক্ষিত হয় যে, যেখানে শীতকালে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকার কথা, গাছপালা ও জলাভূমি কম থাকার কারণে বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে স্বাভাবিকের থেকে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গাছ নিধন নয় বরং গাছকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে, যেমনটি হয়ে থাকে উন্নত দেশগুলোতে। যে উন্নয়ন বাধ্যতামূলক সেখানে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে গাছ স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। ইকোলজিক্যাল বেনিফিটের কথা চিন্তা করে অধিক পরিমাণে গাছপালা রোপণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য তৈরি করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে উন্নয়ন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট যারা আছেন পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি তাদের বিবেচনায় থাকে না। কিন্তু এই বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় রাখতে পারি তাহলে যে তাপপ্রবাহ বা দাবদাহ এখন চলছে তা থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব।
[অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)]
