বাংলাদেশে যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনার পর এবার বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ক্রমাগত মারাত্মক আকার ধারণ করছে। প্রতিবছরই এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য মূল্যবান প্রাণ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অজস্র মানুষ এবং নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো দুর্বল ভবন নির্মাণ, অগ্নি নিরাপত্তার শিথিল নিয়ম এবং অতিরিক্ত ভিড়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে যেসব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তাদের মধ্যে ২০১০ সালের পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিক ড্রাম গলে গিয়ে বিস্ফোরণ, ২০১২ সালে ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোরবেলা গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে এবং ১৫ মার্চ দিবাগত রাতে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে লোগো অগ্নিকাণ্ড, ২০১৯ সালে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ২০২১ সালে মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটের বিস্ফোরণ এবং ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডতে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো আজও মানবমনে বিভীষিকার জš§ দেয়।
এ বছরের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই শুধু রাজধানীতে ঘটে যাওয়া একাধিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আবারও ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোডের বিধি লঙ্ঘন এবং অগ্নি নিরাপত্তা সচেতনতার অভাবের কারণে অধিক জনসংখ্যার মেগাসিটিতে বিস্ফোরণ এবং আগুনের ঝুঁকি সর্বত্র লুকিয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ, ফেব্রুয়য়ারি এবং মার্চ মাসের মধ্যে এই ধরনের কয়েকটি ঘটনা বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
গত ১৯ ফেব্রুয়?ারি ঢাকার গুলশানে একটি বহুতল ভবনে আগুন লাগে। নারায়?ণগঞ্জে পোশাক তৈরির একটি কারখানা ৩ মার্চ বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে? যায়? যেখানে সৌভাগ্যবশত কারখানা বন্ধ থাকার কারণে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পেও অগ্নিকাণ্ড একটি স্থায়?ী সমস্যা, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি প্রধান অবদানকারী। এরপর ৫ মার্চ ঢাকার সায়ে?েন্স ল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটে। গুলিস্তান বিস্ফোরণের মাত্র দুদিন পরে ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে এবং অতি সাম্প্রতিক ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।
প্রতিটি বিস্ফোরণের ঘটনার পরপরই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক দপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়?। বিভিন্ন উৎসের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকলেও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়ে থাকে পানির ট্যাংকে দীর্ঘদিন জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণের ফলে, গ্যাস সরবরাহ লাইনে লিকেজ বা ছিদ্র থাকার কারণে, সিলিন্ডার বা বয়লার বিস্ফোরণ, রাসায়নিক বিক্রিয়া, উচ্চতাপে অথবা বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে। অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ, নির্মিত ভবনগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার, শিথিল অগ্নি নিরাপত্তা বিধিমালা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অগ্নি নিরাপত্তা সচেতনতার অভাবকেই অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর সারাদেশে ঘটে যাওয়া সব অগ্নিকাণ্ড এবং এর কারণসহ একটি করে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে গত ৮ বছরের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতি বছরই পূর্ববর্তী বছর হতে বার্ষিক অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিসংখ্যান পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, বিগত ৮ বছরে সর্বমোট ১ লাখ ৬২ হাজার ৪২৬টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২২ সালে সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। তাই বার্ষিক ক্রমানুযায়ী ২০২২ সাল প্রথম স্থানে অবস্থান করছে এবং ২০১৯ ও ২০২১ সাল যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ০.১২ শতাংশ এবং ২০২১ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১১.৪৪ শতাংশ বেশি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি, ২০১৯ সালে ২৪ হাজার ৭৪টি এবং ২০২১ সালে ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ক্যাপস কর্তৃক গবেষণাকৃত প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে আরও জানা যায়, শুধু বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণেই ৬০ হাজার ৫৫৭টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়, যা মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৩৭ শতাংশ। এছাড়া চুলার (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা ইত্যাদি) মাধ্যমে ২৯ হাজার ৭৮০টি (১৮ শতাংশ), বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরার কারণে ২৫ হাজার ১৩৯টি (১৫ শতাংশ) এবং অন্যান্য বা অজ্ঞাত কারণে ১৬ হাজার ৮৩০টি (১০ শতাংশ) অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। অন্যদিকে ২০২৩ সালে মাত্র চার মাসের মধ্যেই সারাদেশে ২৩টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ক্যাপসের গবেষণায় আরও পরিলক্ষিত হয় যে, সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডগুলো বেশি হয়ে থাকে।
প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝরে যাচ্ছে অগণিত প্রাণ, নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, ভেঙে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের এবং নিজেদের সহায়সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজারো পরিবার। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরপরই তদন্ত কমিটি গঠিত হচ্ছে কিন্তু সঠিক কারণ নিরূপণ করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। আবার আগুনে পুড়ে গিয়ে অনেক প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায়?; এতে অন্তত তিনজন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়?। অপরদিকে, রাজধানীর গুলিস্তান এবং ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায়? একটি পাঁচটি দোকান ভবনে বিস্ফোরণে ২১ জন নিহত এবং ১০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়? (ডেইলি স্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী)। প্রতি বছর আগুন এভাবেই কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন।
কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে এবং আমাদের দুর্যোগ প্রস্তুতি ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের সমস্যা মোকাবিলার জন্য সরকার অগ্নি নিরাপত্তা বিধান প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে?ছে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সারাদেশের সব ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়? নিয়?মিত পরিদর্শন করা। অপরিকল্পিতভাবে তৈরিকৃত ভবনগুলোর সেইফটি ট্যাংক এবং পানির ট্যাংকগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করার ফলে এর ভেতরে গ্যাস জমে যায়। অত্যধিক গ্যাস জমে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। তাই নিয়মিত এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নির্ধারিত সময় পর পর গ্যাসের লাইনগুলোতে লিকেজ বা ছিদ্র পরীক্ষা করতে হবে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনটি অগ্নি নিরাপত্তায় সন্তোষজনক কি না, তা যাচাই করে ভবন নির্মাণের অনুমতি দিতে হবে। অগ্নিনিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি মেরামত করতে হবে। অগ্নি নিরাপত্তা বিধিমালা কঠোরভাবে সবাইকে মানতে বাধ্য করতে হবে। সর্বোপরি জনসাধারণকে অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন করা এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় নিজেকে রক্ষা করা এবং প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল শেখানোর মাধ্যমে কিছুটা হলেও অযাচিত অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে