বিংশ শতাব্দীতে মানুষ যেমন জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে, তেমনি নিজেদের সৃষ্ট কারণেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আমাদের এই বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যা বেশি। বিপুল জনসংখ্যার চলাচলের সুবিধার্থে রাস্তায় রয়েছে লাখ লাখ গাড়ি, কিন্তু রাস্তার আয়তন ছোট হওয়ায় বাড়ছে যানজট। আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা বসবাসের অযোগ্য, ২০১৮ সালে এমনই এক ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। বসবাসের অযোগ্য হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে ‘দূষণ’ ও ‘যানজট’ অন্যতম। দূষণ ও যানজট আন্তঃসম্পর্কিত। সড়কে দীর্ঘ যানজট বায়ুদূষণ বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ঢাকা মেগাসিটিতে অন্তর্ভুক্ত হলেও ঢাকার মতো এত যানজট অন্য কোনো মেগাসিটিতে নেই। জনবহুল এই শহরে সকালবেলায় এখন আর পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে না, পাখির ডাকের জায়গায় অবস্থা নিয়েছে গাড়ির হর্নের বিকট শব্দ। একটা সময় ঢাকা মসজিদের শহর নামে পরিচিত থাকলেও এখন সুধীজনরা ঢাকাকে গাড়ি আর যানজটের শহর বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স, ২০১৯’-এর তথ্য অনুযায়ী যানজটের দিক দিয়ে ঢাকা প্রথম স্থানে রয়েছে। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। মাত্র তিন বছর আগেও বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে ছিল। যানজটের মূল কারণ হিসেবে ট্রাফিক আইনের প্রতি অবহেলা এবং ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে।
বর্তমানে মানুষ এত বেশি গাড়ি ব্যবহার করছে যে, বিশ্বের কয়েকটি দেশের প্রধান সমস্যার মধ্যে যানজট অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই সমস্যার সমাধানের জন্য প্রতিবছর ২২ সেপ্টেম্বর নানা কর্মোদ্যোগ সামনে নিয়ে ‘বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস’ উদ্যাপিত হয়।
২০০০ সালে প্রথম ‘বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস’ পালন করা হয়। আমদের দেশে ২০০৬ সাল থেকে ব্যক্তিগতভাবে এই দিবসটি পালন করা হলেও ২০১৬ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হয়। শহরকে যানজট মুক্ত করা, গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নতি করার লক্ষ্যে সবাইকে আহ্বান করা, সপ্তাহে বা মাসে এক দিন রাস্তাগুলোকে গাড়িমুক্ত করে সংস্কারকাজ ও খালি জায়গা তৈরি করে খেলাধুলা বা বিনোদনের ব্যবস্থা করা, যান্ত্রিকতা থেকে মানুষকে একটু স্বস্তি দেওয়া প্রভৃতি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা এই দিবসের উদ্দেশ্য। বিভিন্ন সংগঠনের প্রয়াসে ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস নামে প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সামনে একটি ইভেন্ট আয়োজন করা হয়।
নামবিও’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে কম যানজটপূর্ণ শহরের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে সুইডেন (গেঙ্গেনবার্গ), সুইজারল্যান্ড (বাসেল) এবং রোমানিয়ার দুটি শহর ব্রাসোভ ও তিমিসোয়ারা। পর্যায়ক্রমে বিশ্বের আরও ১৩টি শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি দেশ হলো নরওয়ে, জার্মানি, ডেনমার্ক, স্পেন ও বেলজিয়াম।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে গণপরিবহন হতে পারত নাগরিকদের চলাচলের জন্য আদর্শ বাহন, সেখানে এখন রয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ির অবস্থান। দিন দিন মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে উৎসাহিত হওয়ার মূলে রয়েছে গণপরিবহনের নানা সীমাবদ্ধতা। প্রথমত, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা। পরিস্থিতি এমন যে মূল লোকসমাগমের স্থান থেকে কোনো রুটে পরিবহনসংখ্যা বেশি, আবার কোনো রুটে তুলনামূলকভাবে কম, যেমন ফার্মগেট থেকে মিরপুরের গাড়ি অন্যান্য রুটের চেয়ে সংখ্যায় বেশি। একই সঙ্গে রয়েছে টিকিট ব্যবস্থা না থাকা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নারীদের অনিরাপত্তা, পরিবহনে আরামদায়ক অবস্থার অভাব প্রভৃতি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া ও সামাজিক অধিপত্য দেখানোর জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে থাকে।
কিন্তু করোনা আমাদের একটি শিক্ষা দিয়েছে যে, কীভাবে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানী চলাচল ও বসবাস-অযোগ্য হয়ে ওঠে। আর নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি ও যানজট না থাকলে ঢাকার একস্থান থেকে আরেকস্থান যেন অনেক কাছে চলে আসে। স্বল্পতম সময়ে পৌঁছা যায় গন্তব্যে। থাকে না বায়ু ও শব্দদূষণ। করোনার এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ যোগাযোগ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া যেতে পারে।
ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনে নানাভাবে তুলনা করলে দেখা যায়, ব্যক্তিগত গাড়ি কম কার্যোপযোগিতায় বেশি রাস্তা দখল করে। ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ছয় শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে রাস্তার ৭৬ ভাগ দখল করে আছে। ছয় থেকে আট ভাগ রাস্তা গণপরিবহণের দখলে, আর রাস্তার বাকি অংশ পার্কিং ও অবৈধ দখলে রয়েছে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ সরেজমিনে একটি জরিপ করে। এতে দেখা যায়, তিনটি ব্যক্তিগত গাড়ি ১২ জনকে নিয়ে যে স্থান দখল করে, সেখানে ৩৬ থেকে ৪০ যাত্রী ধারণক্ষমতার একটি বাস স্থান নিতে পারে। অপরদিকে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় যে পরিমাণ জায়গা দখল করে, সমপরিমাণ একটি জায়গায় একটি হিউম্যান হলার (টেম্পো বা লেগুনা) দখল করে। ব্যক্তিগত গাড়িতে চারজন আরোহণ করতে পারে, পক্ষান্তরে হিউম্যান হলারে ১৪ জন আরোহণ করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আরও ভিন্নতা দেখা যায়। বিত্তশালী একটি পরিবারের কমপক্ষে দুই বা ততোধিক গাড়ি থাকে, ফলে মাত্র দুই থেকে চারজনের জন্য যদি গড়ে দুটি গাড়ি রাস্তায় চলাচল করে, ওই পরিমাণ জায়গায় ১২টি বাইসাইকেল চলাচল করতে পারবে।
ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে জৈব জ্বালানির চাহিদা, বাড়ছে বায়ুদূষণ। বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা অনুযায়ী দীর্ঘ যানজটে বসে থেকে প্রতিদিন মানুষের ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, বছরে যার আর্থিক মূল্য ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া যানজটে গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকলে সাধারণ ধোঁয়ার পাশাপাশি ক্ষতিকর আনবার্নড হাইড্রোকার্বন নির্গত হয়, উপরন্তু জ্বালানি তেল বা গ্যাসের অপচয় হয়। দীর্ঘ এই যানজটে গণপরিবহন ও এসি নেই, এমন গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ রাখা সম্ভব হলেও এসি আছে এমন গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ রাখা হয় না, যার তালিকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাই সিংহভাগ। ‘নামবিও’ গবেষণা সূচক অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবস্থান ৩২তম। যানজটে বসে থাকার ফলে চালক ও যাত্রীর মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়, ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায় এবং ব্যক্তিগত জীবন বিষিয়ে ওঠে। গাড়ির নির্গত ধোঁয়ার শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালির প্রদাহ, মাথাধরা, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, বমিভাব, চোখে জ্বালাপোড়া প্রভৃতি শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অল্প জায়গায় বেশি যাত্রী পরিবহন করা যায়, সে ধরনের বাহনকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে বাসের সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। ঢাকায় বর্তমানে প্রাইভেট কারের ব্যবহার অত্যধিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট কারে চলাচল নিরুৎসাহিত করতে পাবলিক বাসসহ হেঁটে ও সাইকেলে চলাচলের সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি পরিহার করে ভালো মানের গাড়ি নামানো উচিত, যেন সব পর্যায়ের মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াতে উৎসাহিত হয়। এসব সুবিধা না থাকায় ঢাকায় অনেকে বাধ্য হয়েই প্রাইভেট কার ব্যবহার করছেন। উন্নত বাস সার্ভিস চালু করার মাধ্যমে প্রাইভেট কারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা সম্ভব। একদিন বেজোড় সংখ্যা এবং অন্যদিন জোড় সংখ্যার নাম্বার প্লেট অনুযায়ী প্রাইভেট গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা যায়। সেক্ষেত্রে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। মোটকথা, যানজট হ্রাসে অতিসত্বর প্রাইভেট কার ব্যবহারে নিরুৎসাহী করতে বাসের যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধিতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জ্বালানি সাশ্রয়, যানজট নিরসন, যানজটে বসে সময় নষ্ট করা প্রভৃতি সমস্যা সমাধানের জন্য সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। সাইকেল এমন একটি বাহন, যা পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত। এছাড়া সাইকেল চালালে মানসিক চাপ কমে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেস উন্নত হয়। আমাদের দেশে সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা সড়ক বা লেন নেই। সাইকেলের জন্য আলাদা লেন করার দাবি জানিয়ে দীর্ঘদিন বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে।
সবশেষে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, করোনা আমাদের একটি শিক্ষা দিয়েছে যে, কীভাবে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানী চলাচল ও বসবাস-অযোগ্য হয়ে ওঠে, আর নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি ও যানজট না থাকলে ঢাকার একস্থান থেকে আরেকস্থান যেন অনেক কাছে চলে আসে। স্বল্পতম সময়ে পৌঁছা যায় গন্তব্যে। থাকে না বায়ু ও শব্দদূষণ। করোনার এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ যোগাযোগ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া যেতে পারে, যা বাস্তবায়িত হলে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি নিরাপদে চলাচল ও যানজট নিরসনের লক্ষ্য পূরণ হবে।