by Team CAPS, 0 Comments
আমাদের বাসভূমি পৃথিবী, কত অত্যাচার সহ্য করে আজো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। মানুষ হলে হয়তো বলত ‘বাবা আমাকে আর মারিস নে’। মানুষের কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যমে পৃথিবীকে মানুষের বসবাস উপযোগী করে তোলার জন্য প্রতি বছরের মতো এ বছরও পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘আসুন প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করি’। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ প্রতি বছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
মানব সভ্যতার উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্লাস্টিক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময় আমরা নানান কাজে কাপড় বা কাগজ ব্যবহার করতাম, কিন্তু আর তা হচ্ছে না মানুষ এখন কাগজ ও কাপড়ের ব্যাগের পরিবর্তে প্লাস্টিক বা পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করছে। প্লাস্টিক অনেক সস্তায় তৈরি করা যায়, যার ফলে ক্রয়মূল্য কম, এ ব্যাগ সহজে ছেড়ে না, এক ব্যাগেই অনেক জিনিস বহন করা যায়। প্লাস্টিকের অন্য রকম আরো একটি সুবিধা হলো এটি সহজে রাসায়নিক বিক্রিয়া অংশগ্রহণ করে না ফলে এর ব্যবহার ক্ষেত্র বিশাল। অপরদিকে প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ হওয়ার এটি পরিবেশে শত বছর ধরে একইরূপে থেকে যায়। অণুজীব কর্তৃক প্লাস্টিক নষ্ট হয় না বরং অণুজীবের ওপর প্লাস্টিকের খারাপ প্রভাব রয়েছে। সেলুলোজ, প্লাস্টিসাইজার ও অন্যান্য দ্রাবক পদার্থের সমন্বয়ে ১৮৮৫ সালে আলেকজান্ডার পার্ক নামের এক উদ্ভাবক প্রথম প্লাস্টিক তৈরি করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে প্লাস্টিক প্রকৃতিতে নষ্ট হতে কমপক্ষে ৫০০ বছর সময় লাগে, এ হিসাবে এই পর্যন্ত উৎপাদিত কোনো প্লাস্টিকই প্রকৃতিতে পচে যায়নি। American Association for the Advancement of Science-এর প্লাস্টিক ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে প্লাস্টিকের উৎপাদন ছিল ২ দশমিক ২ টন, ২০১৫ সালে তার পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৪৪৮ মিলিয়ন টন। ৬৫ বছরে উৎপাদিত এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের ৩০ শতাংশ এখনো ব্যবহার হচ্ছে, ১২ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে, কিন্তু ৫৮ শতাংশের কোনো হিসাব নেই। হয়তো এই ৫৮ শতাংশের কিছু অংশ চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে আর কিছু মিশে গেছে মহাসাগরে। আন্তর্জাতিক সংস্থা IUCN: International Union for Conservation of Nature এর মতে উৎপাদিত প্লাস্টিকের ২ শতাংশ মহাসাগরে পতিত হয়।
প্লাস্টিক বলতে হয়তো আমরা অনেকেই এখনো পলিথিন বা প্লাস্টিকের তৈরি ঘরোয়া পণ্য কিংবা প্রসাধনীর বোতল এর কথা চিন্তা করে থাকি। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে, প্লাস্টিক শুধু প্রসাধনীর বোতল তৈরিতে নয় এ ছাড়াও এটি প্রসাধনীর মধ্যে থাকা একটি উপাদান, আর তার নাম হচ্ছে মাইক্রোবিড। সাধারণত ১ মিলিমিটার বা তার থেকে সূক্ষ্ণ প্লাস্টিকের কণাকে মাইক্রোবিড বলা হয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় যে ফেসওয়াস, টুথপেস্ট, বডিওয়াস, ডিটারজেন্ট ইত্যাদি পণ্যের মধ্যে সূক্ষ্ণ দানাদার উপাদানের উপস্থিতি আছে, এগুলোই মাইক্রোবিড। নিত্যপ্রয়োজনীয় এ সব পণ্য ব্যবহারের পর এটি সিউয়েজ সিস্টেম দিয়ে মিশে যায় নদী-নালা, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে। সম্প্রতি Environmental and Social Development Organization-ESDO বাংলাদেশের তিনটি বড় গুরুত্বপূর্ণ শহর; ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের নদী, খাল ও অন্যান্য জলাশয়ের ওপর মাইক্রোবিডের প্রভাব নিয়ে একটি বিস্তর গবেষণা করেন। তাদের গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকায় ৬৬২৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন, চট্টগ্রামে ১০৮৭ দশমিক ১৮ বিলিয়ন, সিলেটে ২১২ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মাইক্রোবিড নদী, খাল ও অন্যান্য জলাশয়ের পানিতে মিশে আছে। মাইক্রোবিডের ক্ষতিকর প্রভাব সরাসরি পড়ছে মাছের ওপর। ঊঝউঙ প্রায় ১০০ মাছ নিয়ে গবেষণা করে এবং মাছের পাকস্থলি, মুখ, এমনকি ডিমের মধ্যেও মাইক্রোবিড খুঁজে পেয়েছে। এর মধ্যে রুই ও পুঁটি মাছের আক্রমণের পরিমাণ বেশি। State University of New York-এর একটি গবেষণায় এসেছে যে, গ্রেট লেকের প্রতি ১৫০০ বর্গমাইল এলাকায় প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন মাইক্রোবিড রয়েছে।
বহু চেষ্টা করেও বাংলাদেশে প্লাস্টিক তথা পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। ২০০২ সালে বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) অনুযায়ী ‘সব প্রকার প্লাস্টিক শপিং ব্যাগের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ বিতরণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ’। ২০০২ সালে আইনটি ভালোভাবে কার্যকর থাকলেও ১৬ বছর পরও আইন প্রয়োগের তেমন কার্যকরী প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। বেসরকারি সংস্থা West Concern এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ টন। কিন্তু এর মধ্যে ৯ দশমিক ২ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করা হয়, বাকি অংশ মিশে যায় জলাশয়ে থেকে নদীতে, কিছু অংশের ঠাই মিলে ল্যান্ডফিলে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মতে শুধু বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে জমা হয়ে আছে ১৩ ফুট পলিথিনের আস্তরণ। শীতপ্রধান দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণে সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরি জ্যাকেটের ব্যবহার রয়েছে। European Union-এর গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী ওয়াশিং মেশিন হতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার টন সিনথেটিক ফাইবার পানিতে মিশে যাচ্ছে।
৬ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে United Nations Environment Programme (UNEP) আয়োজিত এক সভায় ১৯৩ দেশের প্রতিনিধি সমুদ্রের পানিতে প্লাস্টিক দূষণ অবসানের জন্য জাতিসংঘের রেজুলেশনে স্বাক্ষর করেন, এর মধ্যে আমাদের বাংলাদেশও রয়েছে। ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন প্রকার সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়, কিন্তু এ সব কিছু কার্যকর হবে যদি আমরা নিজেরা সচেতন হই পাশাপাশি প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) ‘নিষিদ্ধ পলিথিনে পরিবেশ বিপর্যয় এবং পাটজাত ও পরিবেশবান্ধব পণ্যের চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় উল্লেখিত সুপারিশ উল্লেখযোগ্য এর এক ছিল ‘পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড়, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা ব্যবহার করা, এগুলো সহজলভ্য করা এবং এ সব ব্যাগ ও ঠোংগা ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা’। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে দূষণকারী প্লাস্টিক পণ্য হচ্ছে পলিথিন, এর দূষণ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি যদি আমরা আমদের ঐতিহ্য ‘সোনালি আঁশ’ মধ্যে সমাধান খুঁজি। আমাদের দেশের বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘সোনালি ব্যাগ’ হতে পারে এর সমাধান, তার উদ্ভাবিত ব্যাগ পাট হতে তৈরি যা প্রকৃতিতে সম্পূর্ণরূপে পচে যায়।
