by Team CAPS, 0 Comments
শপিংয়ের নাম শুনলে মন ভালো হয় না এমন কোনো মানুষ হয়তো খঁুজে পাওয়া যাবে না। কেনাকাটা সবার পছন্দের বিষয়। শপিং মলগুলোতে সারা বছর বেচাকেনার চাপ লেগেই থাকে; বিশেষ করে ঈদ এবং পূজাতে দোকানিদের হিমশিম খেতে হয়। উঁচু ভলিউমে গান শুনা, কেনাকাটা, আর এর এক ফঁাকে খাওয়া-দাওয়ায় জমজমাট অবস্থা। আর এ জমজমাট অবস্থার মধ্যে একটু অসচেতনতা বিপদের কারণ হয়ে দঁাড়াতে পারে। এত আনন্দের ভিড়ে কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি, মুহূতের্ই আনন্দ কান্নায় পরিণত হতে পারে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ শপিং মলগুলোই নিরাপত্তার পরোয়া না করেই চলছে। এত বেশি অনিয়ম, যে এখন অনিয়ম দেখলেই আমরা এড়িয়ে চলি। কথায় আছে “সবর্ অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা”? আমাদের শপিং সেন্টারগুলোতে প্রচুর অনিয়ম। শপিং সেন্টারের পরিবেশ খুবই খারাপ; নেই পযার্প্ত অগ্নিনিবার্পক ব্যবস্থা, প্রতিনিয়ত ঘটছে শব্দ দূষণ, প্রতিদিনই কোনো না কোনো লিফট দুঘর্টনা, অনেক শপিং সেন্টারেরই পাকির্ং ব্যবস্থা নেই। এসব বিষয়ের সমাধানের পদক্ষেপ আমাদের এখনই নিতে হবে।
অগ্নিনিবার্পক ব্যবস্থা : রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবন নিমাের্ণর ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে আগুন নেভানোর জন্য পযার্প্ত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে উল্লেখ আছে। কিন্তু অধিকাংশ ভবন মালিক এই নিয়ম মেনে চলছে না। এমনকি ঢাকার বড় শপিং মল ও রেস্টুরেন্টগুলোর ভবন তৈরির সময় বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। আর আগুন লাগলে বরাবরের মতো নগরবাসী শুধু দমকল বাহিনীর ওপর নিভর্র করায় অগ্নি দুঘর্টনায় জানমালের ক্ষতির পরিমাণও কমানো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে অগ্নি দুঘর্টনারোধে এক ধরনের নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। এ নিয়ে বিক্রেতারা কিছুটা শঙ্কিত হলেও মালিক পক্ষ নিরাপত্তার বিষয়ে একেবারে উদাসীন। ঝুঁকিপূণর্ শপিং মল/মাকের্টগুলোকে অক্সিজেন সিলিন্ডার, পানির রিজাভর্ ট্যাংক, বালুভতির্ বালতি ও রেসকিউ সিঁড়িসহ অন্যান্য অগ্নিনিবার্পণসামগ্রীও নেই। তা ছাড়া বিল্ডিংগুলো বানানোর সময়ও বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। মাকের্টগুলোতে অগ্নিনিবার্পণের পযার্প্ত ব্যবস্থা নেই। মাকের্টগুলোতে অগ্নি ও দুঘর্টনা মোকাবেলার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল না থাকার দরুন আগুন লাগলে সাময়িক পরিস্থিতির সামাল দেয়া যায় না। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যায়। মাকের্টগুলোতে ট্রান্সফরমার, জেনারেটর, বিদ্যুতের সাবস্টেশন সব এক জায়গায় থাকার কারণে অগ্নি দুঘর্টনা ঘটার পর খুব সহজেই তা ছড়িয়ে পড়ে। খুব কম সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় অগ্নিনিবার্পক কোনো উপকরণ থাকলে সেগুলো উপযোগিতা পাওয়া যায় না।
শব্দ দূষণ: শপিং মল/ মাকের্টগুলোতে অবিরাম চলছে উচ্চস্বরে বিভিন্ন ধরনের গান-বাজনা, দর কষাকষি। শুধু তাই নয়, সেলাই মেশিন ও জেনারেটরের শব্দ তো আছেই। ক্রেতাদের নিজের দোকানের দিকে আকষর্ণ করানোর জন্য উচ্চস্বরে মাইক লাগিয়ে প্রচার চালাচ্ছে দোকানিরা। এ ছাড়া শপিং সেন্টারের খাবার দোকানগুলোতে ক্রেতাদের উচ্চস্বরে ডাকাডাকি। বাংলাদেশে শব্দ দূষণ বতর্মানে এমন পযাের্য় পেঁৗছেছে যে, একে ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করা হয়। এটি বাংলাদেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একটি প্রধান ঝুঁকিপূণর্ বিষয়। শব্দদূষণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে বাণিজ্যিক এলাকার শব্দের মানমাত্রা হওয়া উচিত ৬০-৭০ ডিবি। প্রকৃতপক্ষে শব্দ দূষণের কারণে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ বধিরতা থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া পযর্ন্ত বেশ কিছু মারাত্মক রোগের শিকার হচ্ছে। শব্দের মাত্রা ৪৫ ডিবি হলেই সাধারণত মানুষ ঘুমাতে পারে না। ৬০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ মানুষকে অস্থায়ী বধির করে দেয়। ৮৫ ডিবিতে শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে ১০০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ মানুষকে স্থায়ীভাবে বধির করে দেয় এবং মাত্রা ১২০ ডিবি হলে কানে ব্যথা শুরু হয়।
লিফট ব্যবস্থা: লিফট এখন শহরবাসীর জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু। লিফট ছাড়া বহুতল ভবন কল্পনা করা যায় না। এটির ব্যবহার যেমন সুবিধা সৃষ্টি করেছে, তেমন ঝুঁকিও বেড়েছে। সিঁড়ি না বেয়ে লিফটের মাধ্যমে মুহূতের্ই বহুতল ভবনে ওঠা যায় আবার এর ত্রæটির কারণে মুহ‚তের্ই লাশ হতে পারে। শুধু বাসা বাড়িতে নয়, বিভিন্ন শপিং সেন্টারে লিফটের সুব্যবস্থা রয়েছে। বিশাল শপিং সেন্টারের প্রত্যেক ফ্লোরের সুবিধা নিতে লিফট একটি গুরুত্বপূণর্ উপকরণ। শপিং সেন্টারে লিফটের ব্যবহার চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। লিফট ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনার। আর এই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটু দায়িত্বের অবহেলা ডেকে আনতে পারে সারা জীবনের দুভোর্গ। প্রতিনিয়তই রাজধানীর বিভিন্ন শপিং সেন্টারে লিফট অব্যবস্থাপনার কারণে সংঘটিত দুঘর্টনার কথা শোনা যায়। রাজধানীর চামেলীবাগে আবাসিক কমপ্লেক্সের লিফটের দুই দরজার চাপায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটি এককথায় ভয়াবহ হত্যাকাÐ। লিফটের তার ছিঁড়ে পড়ে যাওয়া বা লিফটের দরজায় আটকে মারা যাওয়া এ ধরনের ঘটনাকে আমরা দুঘর্টনা না বলে অবহেলাজনিত হত্যাকাÐ বলতে পারি। বিভিন্ন শপিং মলগুলোতে লাভের কথা ভেবে নিম্নমানের লিফট লাগানো হয়। আবার ত্রæটিপূণর্ লিফট মেরামতে কতৃর্পক্ষ অনীহা এই ধরনের দুঘর্টনা ঘটার জন্য দায়ী।
পাকির্ং: শপিং মলগুলোর পাকির্ং ব্যবস্থা খুবই নাজুক। গাড়ির পাকির্ংয়ের জন্য পযার্প্ত পরিমাণ জায়গা না রেখেই গড়ে উঠেছে বড় বড় শপিং মল। ফলে অনেককেই গাড়ি পাকর্ করতে হচ্ছে মাকেের্টর সামনের রাস্তায়। অবৈধ পাকির্ংয়ের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। রাজধানীর ধানমÐি এলাকার সাতমসজিদ রোডে কমর্ দিবসে যানজট নিত্য বিষয়, কিন্তু বন্ধের দিনগুলোতে এই চিত্রে ব্যতিক্রম হয় না। কম প্রশস্ত রাস্তায় দীঘর্ যানজটের লাইন লেগে থাকে। আবার বেশিরভাগ শপিং মলের জেনারেটর রাখা হয় পাকির্ং এরিয়াতে। এতে পাকির্ংয়ের মতো বদ্ধ জায়গায় তাপমাত্রা বাড়ে ও কম্পন অনুভ‚ত হয়। যা ড্রাইভারের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
স্টামফোডর্ ইউনিভাসিির্ট পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা: স্টামফোডর্ ইউনিভাসিির্টর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ২০১৬ সালে ধানমÐির ১২টি শপিং সেন্টার এ গবেষণা করে। গবেষণার অন্তভুর্ক্ত বিষয়সমূহ হলো অগ্নিনিবার্পক ব্যবস্থা, জেনারেটর থেকে সৃষ্ট শব্দ ও কম্পন, মেডিকেল ফেসিলিটি, টয়লেট ব্যবস্থা, সিকিউরিটি ব্যবস্থা, বাচ্চাদের দেখাশোনার রুম, সিসি টিভি ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা যায়, ১১টি শপিং সেন্টারে অগ্নিনিবার্পক ব্যবস্থা ছিল, তবে নিয়মিত মহড়া হয় না কোনোটিতেই। এ ক্ষেত্রে জরুরি এক্সিট ৪টিতে ও শব্দ সৃষ্টকারী জেনারেটর ছিল ৯টি শপিং মলে। ৬টি শপিং সেন্টারের ছিল নিজেদের সিকিউরিটি ব্যবস্থা, অন্যান্য ৬টি শপিং সেন্টারে আছে আনসার এবং প্রাইভেট সিকিউরিটি ব্যবস্থা। ৭টি শপিং সেন্টারে সি সি টিভি মনিটরিং রয়েছে, মেডিকেল ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি কোনো শপিং সেন্টারে। এ ছাড়া মাত্র ১টি মাকেের্ট স্মোকিং জোন থাকলেও কোনো শপিং মলেই বাচ্চাদের দেখাশোনার রুমের ব্যবস্থা নেই।
শাস্তি ও আইন : বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন -১৯৯৫ এর আওতায় শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নিধার্রণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদÐ বা অনধিক পঁাচ হাজার টাকা অথর্দÐ অথবা উভয় দÐ এবং পরবতীর্ অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদÐ বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অথর্দÐ অথবা উভয় দÐে দÐিত হওয়ার বিধান রয়েছে। রাজউক ইমারত নিমার্ণ বিধিমালা-২০০৮ পবর্-১ এর ১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেকটি বিল্ডিংয়ে “অগ্নি-প্রতিরোধক দরজা” অথর্ বিশেষভাবে তৈরি দরজা যাহা নিদির্ষ্ট সময়ের জন্য তাপ ও আগুন সঞ্চালনের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে, “অগ্নি-প্রতিরোধক উপকরণ” অথর্ অগ্নি-প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পূণর্ নিমার্ণ উপকরণ, “অগ্নি নিরাপদ সিঁড়ি” অথর্ বিভিন্ন তলা থেকে ল্যান্ডিং বা লবি দ্বারা সংযোজিত সিঁড়ি যাহা অগ্নি প্রতিরোধক দরজা দ্বারা মূল বিল্ডিং থেকে আলাদা হবে এবং ইমারতের বহিভাের্গ খোলা স্থানের সহিত উন্মুক্ত থাকবে।
প্রয়োজন সচেনতার ও আইনের বাস্তবায়ন। ভালোমানের ইলেকট্রিক ওয়ার ব্যবহার করতে হবে। জোড়া দেয়ার সময় উন্নতমানের ইন্সুলেশন ব্যবহার করতে হবে। প্রত্যেক শপিং সেন্টারে কয়েকদিন পর পর অগ্নিনিবার্পক মহড়া করতে হবে। তাহলে সবাই দুঘর্টনার ব্যাপারে সচেতন থাকবে এবং সহজেই দুঘর্টনা মোকাবেলা করতে পারবে। দুঘর্টনা ঘটার পর সচেতন না হয়ে দুঘর্টনা ঘটার আগেই সচেতন হওয়া উচিত। ভবন ব্যবস্থাপনার জন্য যারা কমর্রত আছেন তারা যেন নিয়মিত তাদের ভবনের লিফটের যান্ত্রিক ত্রæটি পরীক্ষা করার পাশাপাশি কোনো রকম ত্রæটি দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রæত সারানোর ব্যবস্থা করেন। উচ্চ শব্দের কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতির ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করতে হবে। শপিং সেন্টারগুলোতে পাকির্ংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে তাহলে যানজটের পরিমাণ কমে আসবে। রাস্তার পাশে পাকির্ং করলে জরিমানা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাযর্করি ভ‚মিকা রাখতে পারে ট্রাফিকরা।
বিল্ডিং কোড আমান্য করে যদি কেউ বিল্ডিং তৈরি করে সে ক্ষেত্রে পযার্প্ত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ ভবন তৈরি করার ক্ষেত্রে অকুপেন্সি সাটিির্ফকেট জরুরি বিষয়। বাড়ি তৈরির পর একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর অনুমোদিত অকুপেন্সি সাটিির্ফকেট অবশ্যই নিতে হবে। শব্দ দূষণের জন্য যেসব শাস্তি নিধাির্রত আছে তা কাযর্কর করতে হবে। অসাবধানতা-অসতকর্তায় আর যেন কাউকে প্রাণ দিতে না হয়। শপিং সেন্টার কতৃর্পক্ষের উচিত শুধুমাত্র লাভের কথা না ভেবে শপিং মলের পরিবেশ ঠিক রাখা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
