by Team CAPS, 0 Comments
বিদ্যমান দূষণগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ইভ্যালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রণীত প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ‘এনহ্যান্সিং অপরচুনিটিস ফর কিন অ্যান্ড রিজিলিয়েন্ট গ্রোথ ইন আরবান বাংলাদেশ : কান্ট্রি এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস-২০১৮’ প্রতিবেদন অনুযায়ী দূষণজনিত কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেছে ৮০ হাজার ২৯৪ জন। বায়ুদূষণজনিত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার মানুষের, শুধু ঢাকায় মৃত্যু ঘটে ১০ হাজার মানুষের। নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউর সহায়তায় সরকারের পরিবেশ অধিদফতর ২০১৬ সালে বায়ুদূষণের উৎস চিহ্নিতকরণ-বিষয়ক এক গবেষণা করেছে। সে অনুযায়ী ইটের ভাটা ৫৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জ্বালানি বা কাঠ পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ৬ শতাংশ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী।
শুষ্ক মওসুমে ঢাকার আশপাশে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইটভাটায় পোড়ানো হয় কাঠ-কয়লা, কাঠের গুঁড়া, ফার্নেস অয়েল, বাতিল হওয়া টায়ার। ফলে নির্গত হচ্ছে পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM2.5 I PM10), কার্বন মনোক্সাইড (CO), সালফারের অক্সাইডগুলো (SOX) এবং নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ (NOX), যা দূষিত করছে ঢাকার বায়ু। পার্টিকুলেট ম্যাটারকে (PM2.5) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ক্যান্সার সংস্থা ‘জি-১ কার্সিনোজেন’ তালিকাভুক্ত করেছে। সালফার ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড হাঁপানি রোগের কারণ। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ঘটায় এবং ফুসফুসের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। সালফার ডাই-অক্সাইডের ভূমিকা রয়েছে সিওপিডি এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের বৃদ্ধিতে। কার্বন মনোক্সাইডের ফলে শিশুর জন্মগত ঝুঁকি, যেমন জন্মের সময় কম ওজন এবং জন্মগত মৃত্যু হার বৃদ্ধি পায়। অথচ ইটভাটার দূষণ রোধে রয়েছে ‘ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনÑ ২০১৩’। এই আইনের ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ীÑ ‘জ্বালানি কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ : আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ ধারা-৬ লঙ্ঘনকারীর দণ্ড : ‘যদি কোনো ব্যক্তি ধারা-৬ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া, ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করেন। তাহা হইলে তিনি অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কয়লার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ : ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে নির্ধারিত মানমাত্রার অতিরিক্ত সালফার, অ্যাশ, মারকারি বা অনুরূপ উপাদান সম্বলিত কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ ধারা-৭ লঙ্ঘন কারীর দণ্ড : ‘যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৬-এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া, ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে নির্ধারিত মানমাত্রার অতিরিক্ত সালফার, অ্যাশ, মারকারি বা অনুরূপ উপাদান সম্বলিত কয়লা ব্যবহার করে, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। বায়ুদূষণ রোধে ইট তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও কম সালফারযুক্ত কয়লার ব্যবহার করিতে হইবে। ইটভাটার দূষণ রোধে ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন আইন মেনে চলিতে হবে।
জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানোর ফলে, শিল্পকারখানা, যানবাহনের অসম্পূর্ণ দহন থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের পার্টিকুলেট ম্যাটার, অ্যাশ, ধূলিকণা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডগুলো এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়তই মিশে যাচ্ছে বায়ুতে। যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া রোধেÑ ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরণ আইন ১৯৯৫’ এর ধারা ৬ এর উপধারা (১) অনুযায়ীÑ ‘স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাইবে না বা ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনোভাবে ওই যানবাহন চালু করা যাইবে না।’ ধারা ৬ এর উপ-ধারা (১) এর বিধান লঙ্ঘনকারীর প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড; দ্বিতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হবে।
১৯৮৩ সালের ‘মোটরযান আইন’ ধারা ১৫০ (ধোঁয়া বাহির হওয়া মোটরযান ব্যবহার) : এমনভাবে ধোঁয়া বাহির হয় যাহার ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হইতে পারে, অনুরূপ মোটরগাড়ি কেহ প্রকাশ্য স্থানে চালাইলে, সর্বোচ্চ দুইশত টাকা জরিমানা হইবে। ধারা-১৫২ (রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস সার্টিফিকেট অথবা পারমিট ব্যতীত মটরগাড়ি ব্যবহার) : কোনো ব্যক্তি ৩২, ৪৭, ৫১(১) উপধারা অনুযায়ী পারমিট ব্যতীত মোটরগাড়ি চালাইলে প্রথমবার অপরাধের জন্য সর্বাধিক তিন মাস কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে। এই উৎসগুলো বন্ধ করার ক্ষেত্রে যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভার্টার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হইবে। ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজি গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করিতে হইবে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করিয়া পাবলিক পরিবহন ব্যবহারের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করিতে হইবে।’
শুষ্ক মওসুমের শুরুতে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ ও রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত এবং সংস্কারের কার্যক্রমের জন্য রাস্তা খোঁড়ার কারণে বায়ুতে পার্টিকুলেট ম্যাটার PM2.5 ও PM10 মিশ্রিত হয়ে যায়। ড্রেন পরিষ্কারের পর বর্জ্যসমূহ রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা হয়, ড্রেনের বর্জ্যে প্যাথোজেনের উপস্থিতি থাকার দরুন, নির্মল বায়ু হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর। ভবন নির্মাণসামগ্রী (ইট, বালু, মাটি, সিমেন্ট, খোয়া) এক স্থান থেকে অন্যত্র আচ্ছাদনহীনভাবে পরিবহন, পুরাতন ভবন ভাঙা, নতুন ভবন নির্মাণ, প্রভৃতি কারণে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায়। ব্যাটারি, পেট্রল, ডিজেল, হেয়ার ড্রাই, পাউডার রঙ প্রভৃতি পণ্য থেকে বায়ুতে সিসা মিশ্রিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ ইঞ্জিন পরিচালনা, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি তৈরি এবং ভারী ধাতু নিষ্কাশনের সময় সিসা ও ক্যাডমিয়াম জাতীয় ভারী ধাতু বায়ুতে মিশে বায়ুকে বিষাক্ত করে তোলে। ভারী ধাতুর মধ্যে সিসা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ; সিসা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে ক্ষতি করে। এ ছাড়াও রং, সিলমোহর ও কাঠশিল্প থেকে ফরমাল ডিহাইডের উপস্থিতি বায়ুর গুণমান নষ্ট করছে এবং এগুলোর কারণে গলা, চোখ আর নাকে জ্বালাপোড়া করে। কিছু ক্ষেত্রে এটি ক্যানসারের জন্য দায়ী। গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত, কয়লার চুলা এবং জ্বলন্ত কাঠ থেকে অতিুদ্র কার্বন কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বায়ুকে দূষিত করছে। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখার কারণে রোগজীবাণু ধুলার সাথে মিশে বায়ু দূষিত করছে। অ্যাসবেস্টস সাধারণত রঙ, লেপ, বিল্ডিং উপকরণ ও মেঝের টাইলস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অ্যাসবেস্টসের কারণে মানুষের দেহে ফুসফুসের ক্যান্সার, অ্যাসবেসোসিস, মেসোথেলিওমা এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে। বাড়ি নির্মাণ সম্পর্কিত নীতিমালা মেনে চলতে হবে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সব আবর্জনা ফেলতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে। সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা করে সব মন্ত্রণালয়কে একই সময় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে হবে। তাহলে বিভিন্ন সময় বায়ুদূষণের পরিমাণ কমে আসবে। যতটা সম্ভব, বিভিন্ন পণ্যে ভারী ধাতু ব্যবহার না করা এবং বিকল্প পণ্য ব্যবহার করা উচিত।
বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। এ থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয়পর্যায়ে সুসমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। মিডিয়াতে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। একই সাথে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ একান্ত প্রয়োজন। প্রচলিত আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। জনগণকে বায়ুদূষণের সামগ্রিক বিষয়ে তথ্য প্রদান, শিক্ষিতকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণ খুবই জরুরি। বায়ুদূষণের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে, ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে এ সমস্যা মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে হবে।