১১ নভেম্বর ছিল জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের ষষ্ঠ দিন। এ দিনকে জাতিসংঘ কপ২৭ এর ডিকার্বনাইজেশন দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। মূলত বিভিন্ন সেক্টর থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পাওয়ার সেক্টর, সড়ক পরিবহন, স্টিল শিল্প, হাইড্রোজেন জ্বালানি এবং কৃষি—এই ৫টি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আগামী ১২ মাসের মধ্যে অর্থাৎ কপ২৮ আগে ডিকার্বনাইজেশন বা কার্বনমুক্তকরণকে গতিশীল করতে ২৫টি সমন্বিত উদ্যাগের মাধ্যমে একটি অ্যাকশন প্লান করা হয়েছে। এই প্লানের মাধ্যমে সস্তায় ও সহজলভ্যভাবে ক্লিন এনার্জি মানুষের দৌরগোড়ায় পৌঁছে যাবে বলে বিশ্বনেতারা আশাবাদী।
তেল, গ্যাস, স্টিল এবং সিমেন্ট শিল্প গুলো কার্বন নিঃসরণ বেশি করা থাকে, পৃথিবীর প্রায় ২৫% এর বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয় এই শিল্পগুলো থেকে। এই শিল্পগুলোর মধ্যে স্টিল শিল্পে কার্বন নিঃসরণে পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অপরিহার্য এই শিল্প বন্ধ করা যাবে না। তাই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে এই শিল্পে কিভাবে কার্বন নিঃসরণ তা নিয়ে বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তেল ও গ্যাস শিল্পের কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্বব্যাপী ১০% এর বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হচ্ছে।
এছাড়াও তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সময় মিথেন গ্যাস লিকেজ হয়ে থাকে; মিথেন একটি গ্রিনহাউজ গ্যাস যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। তাই নবায়নযোগ্য বিকল্প জ্বালানির দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মিথেন নিঃসরণ ৩০% কমানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিশ্বের ১২২টি দেশ বিশ্ব মিথেন চুক্তিতে যুক্ত হয়েছে। কপ২৭ এর আজকের আলোচনায় টেকনোলজি ট্রান্সফার, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এবং ফাইনান্সিংয়ের মাধ্যমে কিভাবে তেল এবং গ্যাস ইন্ডাস্ট্রি থেকে মানবসৃষ্ট মিথেন নিঃসরণ কমানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সবাই একমত হয়েছে যে, আমাদের এখন কম কার্বন নির্গমন করে অথবা প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করে এমন স্টিল কারখানা এবং হাইড্রোজেনের চালিত শক্তি ও টেকসই ব্যাটারি শিল্পের প্রয়োজন।
এজন্য বিশ্বস্ততা এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিলিয়ন পাউন্ডের ইনভেস্টমেন্ট দরকার। কমপক্ষে ৫০টি বড় আকারের প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করে এমন শিল্প কারখানা এবং কমপক্ষে ১০০টি হাইড্রোজেন শক্তিধারা পরিচালিত অঞ্চল গঠন করতে হবে। পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। প্যারিস চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ২০৪০ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহন হতে দূষণ রোধ করার জন্য ২০৪০ সালের মধ্যে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
সার হচ্ছে কৃষি উৎপাদনের অপরিহার্য একটি উপাদান, কিন্ত কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও বর্জ্য হতে প্রচুর পরিমানে নাইট্রাস অক্সাইড উৎপাদন হয়। US EPA এর তথ্যমতে ২০২০ সালে আমেরিকাতে মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাস নিসঃরণের মোট পরিমানের ৭% এর জন্য দায়ী ছিল নাইট্রাস অক্সাইড। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ অবক্ষয়র রোধে করতে আমাদেরকে কৃষিখাতে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে।
বিশ্বের ৭% কার্বন ডাই অক্সাইড নিসঃরণ হয়ে থাকে সিমেন্ট শিল্প হতে। এই শিল্পের কাঁচামাল থেকে খাদ ও উদ্বায়ী পদার্থ দূর করতে উচ্চতাপ প্রয়োগে প্রচুর কার্বন নিসঃরণ হয়ে থাকে। কিন্তু অপরিহার্য এই শিল্প বন্ধ করা যাবে না। তাই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে এই শিল্পে কিভাবে কার্বন নিঃসরণ তা নিয়ে বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া দেওয়া হচ্ছে। শিল্পে কার্বনমুক্তকরণের জন্য কপ২৬ এ ফাস্ট মুভার্স কোয়ালিশন গঠন করা হয়েছিল, তারা এখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তাদের অর্ন্তভূক্ত নতুন ১০টি কর্পোরেট কোম্পানিগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০% প্রায় শূন্য কার্বন নিঃসরণ করে এমন সিমেন্ট ও কংক্রিট ক্রয় করবে।
ডিকার্বনাইজেশন বা কার্বনমুক্তকরণকে গতিশীল করতে পরিবেশবান্ধব শিল্পপণ্য তৈরি করতে সরকারি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিল্পের মান উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধিতে বিলিয়ন পাউন্ডের ইনভেস্টমেন্ট দরকার। এ ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের বিকল্প কিছু নেই। কপ২৭ আজকের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য জি-সেভেন এ গঠিত ইউরোপিয়ান কমিশন, ভারত, মিশর, মরক্কো সহ অন্যান্য দেশগুলো, নেতৃত স্থানীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং সরকারি মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিল্প খাতে অর্থায়ন এবং নতুন উদ্যোগ গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।