গত ১১ নভেম্বর ২০২২ জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (COP-27) ষষ্ঠ দিনকে ডিকার্বনাইজেশন দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দিনে মূলত বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে কার্বন নিঃসারণের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে আলোচনা করা হয়। বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহন, ইস্পাতশিল্প, হাইড্রোজেন জ্বালানি ও কৃষি—এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আগামী ১২ মাসের মধ্যে, অর্থাৎ কপ-২৮-এর আগে ডিকার্বনাইজেশন বা কার্বনমুক্তকরণ প্রক্রিয়া গতিশীল করতে ২৫টি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে একটি অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে। এই প্ল্যানের মাধ্যমে সস্তায় ও সহজলভ্যভাবে ক্লিন এনার্জি মানুষের দৌরগোড়ায় পৌঁছে যাবে বলে বিশ্বনেতারা আশাবাদী। এই ক্লিন এনার্জির একমাত্র উপায় হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত কপ-২৬-এ ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে দেশের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।
জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও যানবাহন, বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কয়লাসহ তেল ও গ্যাস ব্যবহারের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বায়ুদূষণের ঝুঁকি বাড়িয়েই চলেছে। এমনকি তেল ও গ্যাসশিল্প প্রক্রিয়া থেকে বিশ্বব্যাপী ১০ শতাংশের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হচ্ছে। এ ছাড়া তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সময় মিথেন গ্যাস লিকেজ হয়ে থাকে; মিথেনও একটি গ্রিনহাউস গ্যাস, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। তাই নবায়নযোগ্য বিকল্প জ্বালানির দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মিথেন নিঃসারণ ৩০ শতাংশ কমানোর উদ্দেশ্য সামনে রেখে ইতিমধ্যে বিশ্বের ১২২টি দেশ বিশ্ব মিথেন চুক্তিতে যুক্ত হয়েছে। বিশ্বনেতারা আজ একমত যে বিশ্বস্ততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিলিয়ন পাউন্ডের বিনিয়োগ দরকার। কমপক্ষে ৫০টি বড় আকারের প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করে— এমন শিল্পকারখানা এবং কমপক্ষে ১০০ নবায়নযোগ্য হাইড্রোজেন শক্তির উৎস গঠন করতে হবে। এর পাশাপাশি আন্তসীমান্ত পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০৪০ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহনজাত দূষণ রোধ করার জন্য একটি বাস্তবিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই খুবই নাজুক অবস্থানে রয়েছে। প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণে এখানে মৃত্যুহার যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যান্য কারণের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যতম। বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবপোর্টালে দেওয়া তথ্যমতে, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় মাত্র ৯৪৯ মেগাওয়াট আর ২৪ হাজার ৭৮১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে ফার্নেস তেল, ডিজেল, গ্যাস ও কয়লা পুড়িয়ে। অর্থাৎ দেশের সিংহভাগ বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো হয় জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে। এর মধ্যে বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নারীদের ভূমিকা এবং টেকসই পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। তাই, আজকে সম্মেলনে মূলত জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় নারীদের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ, বিশ্বজুড়ে এ ক্ষেত্রে তাদের সফলতা, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নারীদের ভূমিকা, বিশ্বজুড়ে পানি সম্পদের ঘাটতি, বন্যা, খরা, আন্ত-দেশীয় সহযোগিতা এবং দুর্যোগের পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নতি আলোচনায় গুরুত্ব পায়।
Global Climate Risk Index 2021 of German Watch Report ranked Bangladesh the 7th most affected vulnerable country by extreme weather event during 2000-2019. Between 1900 and 2020, a total 352 incidents occurred in Bangladesh. Around 450 million people were affected by the disasters. It is one of the most affected countries due to disasters within the SAARC region. In 2020 a total of 5.4 million people were affected by monsoon floods which was the 4th worst disasters in the world. It is also imperative that between 1996 and 2015, disaster caused an averaging 0.732% of GDP loss per annum and total economic loss was $2.283 billion. It indicates to the severity of disasters in Bangladesh compared to rest of the Region. Thus, to successfully achieve Sustainable Development Goals, the aspect of Disaster Risk Resilience must be taken into account.
মিসরীয় শহর শারম-আল-শেখে জাতিসংঘের উদ্যোগে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৭ বা কনফারেন্স অব পার্টিজ-২৭) শুরু হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি এ সম্মেলনে উপস্থিত আছেন। এবারের সম্মেলনে অভিযোজন, অর্থায়ন, টেকসই জ্বালানি, নেট জিরো, লস অ্যান্ড ড্যামেজ, ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া গত কপ সম্মেলনগুলোর সফলতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আরও অনেক বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এবারের সম্মেলনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরার প্রধানমন্ত্রী হাভিয়ের এস্ফট জ্যামোরাসহ বিশ্বের ১১০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ও উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহারসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধিরা ছাড়াও এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের মেয়র, সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, জলবায়ুকর্মীসহ অনেকে।
আজ ১২ই নভেম্বর জলবায়ু সম্মেলনের সপ্তম দিনকে অভিযোজন এবং কৃষি দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আজকে মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে কৃষি ক্ষেত্রের অভিযোজন আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। আজকে অভিযোজন এবং কৃষির উপর মোট বারোটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম অধিবেশনে কপ২৭ এর FAST উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।এই উদ্যোগটির লক্ষ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে কৃষি এবং খাদ্যের জন্য আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।দ্বিতীয় অধিবেশনে মাল্টিস্টেকহোল্ডার ও মাল্টিসেক্টরাল উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। এই উদ্যোগটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানব স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ঝুঁকি কমাবে। তৃতীয় অধিবেশনে Climate Response for Sustaining Peace উদ্যেগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। চতুর্থ অধিবেশন মূলত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক যেখানে মূলত জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন আরো কিভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়। পঞ্চম অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে খরা এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য পূর্বাভাস প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তথ্য বিশ্লেষণ কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়। ষষ্ঠ অধিবেশনে কিভাবে আধুনিক প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়। সপ্তম অধিবেশনে ২০১৪ সালে মালবো ডিক্লারেশন এর পর থেকে আফ্রিকা ও আরব দেশগুলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে তার উপর আলোচনা হয়। অষ্টম অধিবেশনে জলবায়ু স্মার্ট-কৃষি এবং খাদ্য উৎপাদনের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ভূমিকা এবং এক্ষেত্রে বেসরকারি ও বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানিগুলো কিভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়। নবম অধিবেশনে জলবায়ু স্মার্ট-কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং গ্রামীণ ক্ষুদ্র কৃষকরা সহজ শর্তে ঋন পাওয়ার উপায় নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। দশম অধিবেশনে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বর্তমান খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়। একাদশ অধিবেশন হচ্ছে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক যেখানে মন্ত্রীরা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের আলোকে কিভাবে Koronivia Joint Work on agriculture বাস্তবায়ন করা যায় তার উপর মতামত প্রদান করেন। দিনের শেষ অর্থাৎ ১২তম অধিবেশনে মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত কিভাবে কৃষি সেক্টর বাড়ানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তা আলোচনায় গুরুত্ব পাই।
পাওয়ার সেক্টর, সড়ক পরিবহন, স্টিল শিল্প, হাইড্রোজেন জ্বালানি এবং কৃষি—এই ৫টি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আগামী ১২ মাসের মধ্যে অর্থাৎ কপ২৮ আগে ডিকার্বনাইজেশন বা কার্বনমুক্তকরণকে গতিশীল করতে ২৫টি সমন্বিত উদ্যাগের মাধ্যমে একটি অ্যাকশন প্লান করা হয়েছে। এই প্লানের মাধ্যমে সস্তায় ও সহজলভ্যভাবে ক্লিন এনার্জি মানুষের দৌরগোড়ায় পৌঁছে যাবে বলে বিশ্বনেতারা আশাবাদী।
জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ২৭ এর প্রথম চার দিনের আলোচনা শেষে এটি মনে হচ্ছে যে, গতবারের কপ২৬ এর তুলনায় এইবারের সম্মেলনটি অনেকখানি সফলতার দিকে যাবে। কারণ, গতকাল মঙ্গলবার স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিঅন কপ২৭ সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ৫.৭ মিলিয়ন ডলার প্রধানের অঙ্গীকার করেন।
জাতিসংঘ বলছে, ভূ-রাজনীতির কারণে জ্বালানি, খাদ্য ও পানির সংকটে আছে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ। আর তাই, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর উপর জোর দিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু, হতাশাই যেনো এই সম্মেলনের রেওয়াজ। যা উঠে এলো জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনিও গুতেরেসের কণ্ঠেও, তিনি বললেন, জলবায়ু নরকের মহাসড়কে বিশ্ব। কারণ, গেলো এক বছরে জাতিসংঘ সম্মেলনের অর্জনের খাতাটা প্রায় শুন্য। সম্মেলনের তৃতীয় দিনের আলোচনায় ছিলো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জ্বালানি সংকট, নিরাপদ খাদ্য আর জলাবায়ু জনিত ক্ষয়ক্ষতির অর্থ যোগান। এবারও ক্ষতিপূরণ আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আধুনিক প্রযুক্তি পাওয়ার দাবি জানাচ্ছেন বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো।