পৃথিবীর প্রতি এর বাসিন্দাদের ভালোবাসা প্রকাশ এবং সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ২২ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসনের হাত ধরে ১৯৭০ সালে ধরিত্রী দিবসের প্রচলন। আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে ২২ এপ্রিল প্রথম ধরিত্রী দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে সংস্থাটির বর্ষপঞ্জিতে এ দিবসকে স্থান দেয়। প্রায় সাড়ে চার কোটি বছর বয়সী এ পৃথিবী মানুষের বসবাসের একমাত্র ঠিকানা। পরিবেশগত সমস্যার সমাধানকে গুরুত্ব দিয়ে এ বছর ধরিত্রী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্লাস্টিক দূষণের সমাপ্তি’। বিভিন্ন দেশে দিবসটি বিভিন্নভাবে পালন করা হয়।
বিশ্বের সমসাময়িক অনেকগুলো পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে একটি হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ, বর্তমানে যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ৫০ বছর ধরে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউটের (ডাব্লিউডাব্লিউআই) বলছে, ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী ২৬ কোটি টন প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছিল। পৃথিবীতে প্রতি বছর মাথাপিছু প্রায় ৬০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় যেখানে উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোতে এর পরিমাণ ১০০ কেজিরও বেশি। জাতিসংঘের পরিবেশ প্রকল্প- ইউনেপের তথ্যমতে উৎপাদিত ও ব্যবহৃত এসব প্লাস্টিকের মাত্র ২২ থেকে ৪৩ শতাংশ নির্দিষ্ট জায়গায় ডাম্পিং হয়। বাকি সব প্লাস্টিকের স্থান হয় নদী বা খাল, সমুদ্র, খোলা জায়গা প্রভৃতিতে। ডাব্লিউডাব্লিউআইর তথ্যমতে, ১ থেকে ২ কোটি টন প্লাস্টিকের শেষ গন্তব্য হচ্ছে সাগর, যার প্রভাবে বিভিন্ন দেশের সাগর ও মহাসাগর প্লাস্টিক দূষণ দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত।
ওয়েস্ট কনসার্নের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু সাড়ে তিন কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করেছে। শ্রীলঙ্কায় এর পরিমাণ ছিল ছয় কেজিরও বেশি। এসব প্লাস্টিক পণ্যের মধ্যে পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার্য প্লাস্টিকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় কম হলেও ক্ষতির পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। প্রথমত, বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক খারাপ হওয়ায় পচনশীল এবং অ-পচনশীল বর্জ্য আলাদাকরণের সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে অ-পচনশীল প্লাস্টিক মাটিতেই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ নদীমাতৃক এবং নি¤œ প্রবাহের দেশ হওয়ায় উজানের পানির সঙ্গে প্রচুর প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের সমভূমির ওপর দিয়ে সাগরে পতিত হচ্ছে। ফলে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কম হলেও বিভিন্ন কারণে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলছে।
প্লাস্টিকের এসব ধ্বংসাবশেষের ফলে মৎস্য ও পর্যটন খাতে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ক্ষতির মূল্য প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার। বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকপণ্যের চেয়ে ইথাইলিন যুক্ত পলিথিন ব্যবহারের পরিমাণ বাংলাদেশে তুলনামূলক বেশি। ছোট থেকে বড় যেকোনো পণ্য প্যাকিংয়ে পলিথিনের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবহারকৃত এই সব পলিথিনের ঠাঁই হচ্ছে নর্দমা, খাল, নদী প্রভৃতি স্থানে। পলিথিনের অনিয়মিত ব্যবস্থাপনা ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য মতে ঢাকা শহরে দৈনিক প্রায় এক কোটি ৪০ লাখেরও বেশি পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে।
মাটির অণুজীব ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য ডি-কম্পোজ করতে পারে না। আবহাওয়ায় প্রভাবিত হয়ে এ বর্জ্য দীর্ঘ মেয়াদে ছোট টুকরো হয়ে বাতাস বা পানিতে মিশতে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে পরিবেশ বা প্রাণীজগতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। সাগর-নদীতে ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো ছোট টুকরা হয়ে মাছের খাবারের মধ্যমে মানবদেহে প্রবেশের আশঙ্কা থাকে। জলজ প্রাণী এসব খাবার হজম করতে না পেরে মারাও যায়। প্লাস্টিক দূষণের প্রভাবে উদ্ভিদ বা জলজ প্রাণীর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানবস্বাস্থ্য। মানবদেহে থাইরয়েডের হরমোন অতিরিক্ত ক্ষরণ এবং বিশেষ করে ক্যানসার, চর্ম ও কিডনি রোগের মতো ভয়াবহ রোগ সৃষ্টির জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী এই প্লাস্টিক।
সম্প্রতি বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে ‘সোনালী ব্যাগ’ নামীয় পাটপণ্য আবিষ্কার করেন। তার মতে, পাটের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ সেলুলোজ রয়েছে, যা পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটপণ্যের ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ কমানো সম্ভব। প্লাস্টিকপণ্যের পুনঃব্যবহার, পুনঃচক্রায়ন করার মতো ব্যবস্থা প্রচলনের মধ্যমেও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাব কমানো যায়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে, এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। সুতরাং, সচেতনতার পাশাপাশি আইনের সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহারের মাধ্যমে ধরিত্রী দিবসের শপথ হোক ‘পলিথিন মুক্ত দেশ গড়ি, মন ও স্বাস্থ্য সুস্থ রাখি’।
