জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সংকট। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব; যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙন এবং জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা প্রভৃতির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’ (কপ)-এর এবারের আসর গত ৩০ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে উদ্বোধন করা হয়।
কপ২৮ সম্মেলন এই বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মেলন। এবারের এই সম্মেলনে বরাবরের মতো এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করা ১৯৮টি দেশের শীর্ষ নেতারা একত্র হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো মোকাবেলা করতে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্যে কথা বলবেন। জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই কনভেনশনের অংশ হিসেবে বরাবরই এই সম্মেলনে মিলিত হয়ে থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অগ্রভাগে থাকা বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এই বছরের জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। চলতি বছরের সম্মেলনে বাংলাদেশ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
বৈশ্বিক স্টক : বাংলাদেশের এজেন্ডার প্রথম ইস্যুটি ‘প্রথম বৈশ্বিক স্টকটেক’ সম্পর্কিত, যা এই বছরের জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বৈশ্বিক মজুদ হলো দেশ এবং অংশীদারদের জন্য একটি প্রক্রিয়া, যেখানে তারা প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির লক্ষ্য পূরণের দিকে সম্মিলিতভাবে কোথায় অগ্রগতি করছে এবং কোথায় নেই, তা দেখার জন্য।
লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল : লস অ্যান্ড ড্যামেজ শব্দটি বোঝায় যে দেশগুলো, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো জলবায়ু সংকটের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে- তারা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
জাতিসংঘ এটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছে : ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে উদ্ভূত ক্ষতি ও ক্ষতির মধ্যে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, সমুদ্রের অ্যাসিডিফিকেশন, হিমবাহ পশ্চাদপসরণ এবং সম্পর্কিত প্রভাব, লবণাক্ততা, ভূমি ও বন অবক্ষয়, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং মরুকরণের মতো ধীরগতির ঘটনাগুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।’
অভিযোজনে বৈশ্বিক লক্ষ্য : গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপ্টেশন জিজিএ প্যারিস চুক্তির ৭.১ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি, যার লক্ষ্য ‘বিশ্বের অভিযোজিত ক্ষমতা বৃদ্ধি, স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস করা।’ জিজিএর উদ্দেশ্য হলো একটি ঐক্যবদ্ধ কাঠামো হিসেবে কাজ করা, যা প্রশমনের মতো একই মাত্রায় অভিযোজনের জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং অর্থ পরিচালনা করতে পারে।
এই বছরের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ ‘বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষ্য’-এর কাঠামো তৈরি ও প্রণয়নে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে চায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ সদস্য দেশগুলোকে তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানে (এনডিসি) বর্ণিত ২০৩০ সালের প্রশমন লক্ষ্যগুলো ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে এবং এলডিসি দেশগুলোতে তহবিল বাড়ানোর জন্য জোর দেবে।
জলবায়ু অর্থায়নে ১০০ বিলিয়ন ডলার : ঢাকার আলোচ্যসূচির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জলবায়ু অর্থায়ন। জাতিসংঘের মতে, জলবায়ু অর্থায়ন বলতে স্থানীয়, জাতীয় বা আন্তর্দেশীয় অর্থায়নকে বোঝায়। সরকারি, বেসরকারি এবং অর্থায়নের বিকল্প উৎস থেকে নেওয়া, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করবে এমন প্রশমন এবং অভিযোজন পদক্ষেপকে সমর্থন করতে চায়।
অভিযোজন তহবিল দ্বিগুণ করা : এই বছরের জলবায়ু সম্মেলনের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা হলো অভিযোজন তহবিল দ্বিগুণ করা। অভিযোজন তহবিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বল সম্প্রদায়গুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করে এমন প্রকল্প এবং কর্মসূচিকে অর্থায়ন করে। দেশের চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অগ্রাধিকারের ওপর ভিত্তি করে উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কপ২৮-এর প্রথম দিনই লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়েছে। প্রথমে বিশ্বব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি তহবিল গঠন করা হবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থ বিতরণ করতে সক্ষম হবে এবং ধনী শিল্পোন্নত দেশ, উদীয়মান অর্থনীতি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ; যেমন- চীন, উপসাগরীয় দেশ এবং কপ২৮ আয়োজক দেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত দ্বারা অর্থায়ন করা হবে।
কপ২৮ জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, মানবতার ইতিহাসে ২০২৩ সালই হতে চলেছে এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিশ্বনেতাদের জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে কাজ করার জন্য মিনতি করে গুতেরেস বলেন, ‘আমরা জলবায়ু ভেঙে পড়ার বাস্তব চিত্র চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।’
কপ২৮ সম্মেলনে একটি নতুন গবেষণাপত্রের ফল উঠে এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে জলবায়ু জরুরি অবস্থার তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। অ্যাডভান্সেস ইন অ্যাটমস্ফিয়ারিক সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় এটি উল্লেখ করেছে যে এশিয়ার বৃহৎ অংশ এবং আমেরিকা মহাদেশের বেশির ভাগ অংশ একটি ব্যতিক্রমী উষ্ণ শীত অনুভব করতে পারে এবং এটি ৯৫ শতাংশ সম্ভাবনা দেয় যে ২০২৩-২৪ শীতের জন্য বিশ্বব্যাপী গড় পৃষ্ঠের তাপমাত্রা একটি নতুন ঐতিহাসিক রেকর্ড স্থাপন করবে।
জার্মান ওয়াচের তথ্য মতে, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত বছরগুলো থেকে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে; যেমন- ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোনের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, অকাল খরা ইত্যাদি। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের একটি প্রধান সমস্যা হলো মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের বিরূপ আচরণের প্রভাবে এই লবণাক্ততা দিন দিন অনেক বেড়ে যাচ্ছে এবং ফলে সেখানে সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি, মানুষের বাস্তুচ্যুতি, কাজের অভাব ইত্যাদি আরো প্রকট হচ্ছে।
একই সঙ্গে ঘন ঘন সাইক্লোন ও বন্যার জন্য আমরা বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ জলবায়ু ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর প্রায় পাঁচ-ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বার্ষিক বাজেট থেকে খরচ করছে। অথচ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে বছরে মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের মতো সহযোগিতা আসছে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কয়েক গুণ বেশি অর্থের প্রয়োজন, যে পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে পাওয়ার জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে। শুধু তা-ই নয় বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছে, তা অর্জন করার জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করতে হবে।
[লেখক : বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
kamrul_sub@hotmail.com]