দুবাই জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮ এর পঞ্চম দিনের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল অর্থ, বাণিজ্য, জবাবদিহিতা। এছাড়াও লস এন্ড ড্যামেজ, মানবাধিকার, জলবায়ু ন্যায্যতা, বায়ুদূষণ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে।
লস এন্ড ড্যামেজ বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলোচক বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মটলে কপ¬-২৮ এর ‘ফাইন্যান্স ডে’ উদ্বোধনী সংবাদ সম্মেলন বলেন, এডাপটেশন, মিটিগেশন এবং লস এন্ড ড্যামেজ এই ৩টি বিষয়ে বিগত কয়েক বছর যাবত কাজ করছি। কিন্তু আধুনিক যুগে বসবাস করেও আমরা তাপমাত্রা এবং চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার রেকর্ড দেখতে পাচ্ছি, এবং তা আমরা সামলাতে পারছি না। এর জন্য লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের আরও উন্নয়ন প্রয়োজন।
সম্মেলনে এক্সনমোবিল এর সিইও এই সপ্তাহের শেষে অভিযোগ করেছেন যে, কপ২৮ এ কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজের উপর যথেষ্ট ফোকাস করা হচ্ছে না, কিন্তু গবেষণায় দেখায় যে, ২০৫০ সালে নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য করতে হলে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বার্ষিক ব্যায়ের একটি নিম্ন ক্ষমতার কার্বন ক্যাপচার স্টোরেজের থেকে অন্তত ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার বেশি খরচ করতে হবে।
এইদিকে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ৩০টি সরকারি গ্রাউন্ড মনিটরিং স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যের উপাত্ত বিশ্লেষণে করে। যেখানে দেখা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বায়ু দূষণ (পিএম ২.৫) থেকে বছরে ১৮৭২ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এই দেশের জনসংখ্যার ৮৮% অভিবাসী যারা বেশীরভাগ সময় ঘরের বাহিরে কাজ করে।
একটি নতুন প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে বৈশ্বিক নেট জিরো লক্ষ মাত্রা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে কারণ বেশিরভাগ দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করার জন্য সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেনি। নেট জিরো এর তথ্য মোতাবেক দেখা গেছে যে বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ৮৮% এটি কভার করে কিন্তু এই নির্গমনের মাত্র ৭% জাতীয় পর্যায়ে ব্যবহারে প্রতিশ্রুতি রয়েছে। মাত্র ১৩% দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির সম্পূর্ণ নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পঞ্চম দিনে, জীবাশ্ম জ্বালানির বিষয়ে কপ-২৮ এর সভাপতি সুলতান আল জাবের বলেছেন যে জীবাশ্ম জ্বালানীর পর্যায়ক্রমে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছানোর জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে প্রয়োজনীয় ছিল না। তিনি বলেন, আসুন মনে রাখা যাক কেন আমরা সবাই এখানে আছি। আমরা সবাই এখানে রয়েছি কারণ আমরা একটি খুব স্পষ্ট আহ্বান জানিয়েছি এবং আমরা এটি সম্পর্কে খুব আগে থেকেই বলেছি এবং আমরা স্পষ্টভাবে এবং বারবার বলেছি যে সংযুক্ত আরব আমিরাত নম্রতা, দায়িত্বের সাথে এই কাজটি গ্রহণ করে এবং আমরা এই বিষয়টির পিছনে জরুরীতা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারি। আমরা এখানে এসেছি কারণ আমরা বিজ্ঞানকে খুব বিশ্বাস করি এবং সম্মান করি। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক নির্গমনের ৪৩% হ্রাস করতে হবে।
সাবেক মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল গোর এক বক্তব্যে বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ করার জন্য দেশগুলির একটি চুক্তি হবে মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। তিনি আরো বলেন, একটি জীবাশ্ম জ্বালানী কোম্পানির সিইওকে কপ-২৮ এর দায়িত্বে রাখা “অযৌক্তিক”।
কপ-২৮ সম্মেলনে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিরা বলেছেন যে তারা জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার দাবি চালিয়ে যাবে এবং এর জন্য সুলতান আল জাবেরকে ধরে রাখবে। পঞ্চম দিন সকালে অ্যালায়েন্স অফ স্মল আইল্যান্ড স্টেটস (এওসিস)-এর এক প্রেস কনফারেন্সে, প্রতিনিধিরা বারবার স্পষ্ট করেছেন যে গ্লোবাল হিটিং এর ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে থাকার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানীকে অবশ্যই খোঁচা দিতে হবে। নিম্ন-উন্নয়নশীল দ্বীপের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
এইদিকে, উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে অনুদান নয় ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিতে দুবাইয়ে কপ-২৮ সম্মেলনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে দক্ষিন এশিয়ার সাংবাদিকরা।সম্মেলন কেন্দ্রের মিডিয়া মিট পয়েন্টের বাইরে ‘উই ওয়ান্ট ক্লাইমেট জাস্টিস’ লেখা ব্যানার হাতে দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকরা এ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালিস্ট’স ফোরাম এই বিক্ষোভের আয়োজন করে। এ সময়ে সংগঠনের সভাপতি ভারতীয় সাংবাদিক আশিস গুপ্তা, মহাসচিব বাংলাদেশের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান সম্রাট, নির্বাহী সভাপতি কেরামত উল্লাহ বিপ্লব, ভাইস প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের রাবনেওয়াজ চৌধুরী, নেপালের শ্রীরাম সুবেদী, ইমরান ওয়াই চৌধুরীসহ আফগানিস্তান ব্যাতীত দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের সাংবাদিকরা বক্তব্য রাখেন।
এছাড়াও বিভিন্ন সাইড ইভেন্টে, মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনা করা হয়। যেখানে বাংলাদেশ সহ জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশ সমূহ থেকে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মীগণ, যুবক, শিশু কিশোর গবেষক অংশগ্রহণ করেন অন্যদিকে এই প্যানেলে মেয়েদের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্যের উপর যে ঝুঁকি সেই বিষয়টি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে নারীরা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়।
উল্লেখ্য যে, গতকাল ১২৩ টি দেশ জলবায়ু ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রথম ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে যার মধ্যে জলবায়ু এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঝুঁকি সমাধানের জন্য অর্থায়ন এবং তাদের জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্য গুলি অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন্দ্রিক জলবায়ু কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য এক বিলিয়ন ডলারের একটি “সমষ্টিগত” তহবিল প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে যা গ্রীন ক্লাইমের ফান্ড, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং রকফেলার ফাউন্ডেশন সহ সংস্থাগুলি থেকে আসে।কিন্তু এটি স্পষ্ট নয় যে এই অর্থের কতটা নতুন এবং এটাও স্পষ্ট নয় যে এটা দুর্বল দেশগুলোর জন্য অনুদান না কি ঋণের কারণ হয়। এই ঘোষণাপত্রে জলবায়ু সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রতিরোধের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির নির্গমন রোধের একক কোন উল্লেখ নেই।